রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে কেন্দ্রীয় সন্ধানী’র ৪১তম ষান্মাসিক সভা
সন্ধানী এদেশের অগণিত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে ———-দানবীর ড. রাগীব আলী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:২৮:০৭ অপরাহ্ন
রক্তের প্রয়োজনে প্রথমেই মানুষ সন্ধানীর কাছে যায় ঃ আরিফুল হক চৌধুরী
মানবিক চিকিৎসক হয়ে দরদ দিয়ে সেবা দেবেন ঃ অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান
স্টাফ রিপোর্টার : ‘সন্ধানী বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচির অগ্রদূত। তাদের এই আন্দোলনের ফলে মানুষের মধ্যে রক্তদান ভীতি দূর হয়েছে এবং চক্ষুদান কর্মসূচির মাধ্যমে দৃষ্টিহীন মানুষ আবারো পৃথিবীর আলোতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। সন্ধানী এদেশের অগণিত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।’
বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃৎ কেন্দ্রীয় ‘সন্ধানী’র ৪১তম ষান্মাসিক সভা-২০২৩ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় উপরোক্ত কথা বলেন অনুষ্ঠানের ‘গেস্ট অব অনার’ জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্ণিং বডির চেয়ারম্যান দানবীর ড. রাগীব আলী। ‘আমার রক্ত সঞ্জীবনী হোক সকল প্রাণের তরে/ দৃষ্টিহীনের স্বপ্ন সাজুক আমার দুচোখ ভরে’ মূলমন্ত্রে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সন্ধানীর ৪১তম ষাম্মাসিক সভায় বক্তারা জানান, এখন পর্যন্ত সন্ধানী মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচির মাধ্যমে ৪ হাজার মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছে এবং ৫ লক্ষাধিক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেছে। এর পাশাপাশি সন্ধানী বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ, ভ্যাকসিন কার্যক্রম, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। মানবসেবার ব্রত নিয়ে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে সন্ধানীর ৩৪টি ইউনিট সফলতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’
গতকাল শুক্রবার জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনুষ্ঠিত সন্ধানী’র ৪১তম কেন্দ্রীয় ষান্মাসিক সভায় দেশের ৩২টি মেডিকেল কলেজ ইউনিট অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টায় কলেজের লেকচার গ্যালারি-১ এ অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সন্ধানী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. আবেদ হোসেন, রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের সদস্য সাদিকা জান্নাত চৌধুরী, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একেএম দাউদ, পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. তারেক আজাদ, সন্ধানী’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডা. মোশারফ হোসেন মুক্ত, সন্ধানীর জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা, মনিলাল আইচ লিটু।
সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি তাহসিন আলম সাইম’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সন্ধানী জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সভাপতি ও সন্ধানীর ৪১তম ষান্মাসিক সভা বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক তারেক জামিল খান নাবিল। ডা. রাজীব আহসান সুমন ও নিশাত আনজুম এর যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সন্ধানী জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডা. ফজলুল হক সোহেল, সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সহ সাধারণ সম্পাদক রাকীব আলী। অনুষ্ঠানে ডা. রাশেদুল কবির ও অধ্যাপক নাজমুল ইসলামকে সন্ধানীর পক্ষ থেকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। শুরুতে কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন গোলাম মাহবুবুর রহমান।
মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ, শিক্ষানুরাগী-সমাজসেবক দানবীর ড. রাগীব আলী ষান্মাসিক সভার সফলতা কামনা করে বলেন, সন্ধানী যেভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে সেভাবে তিনিও সিলেটের মানুষের কল্যাণে মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, রক্তের প্রয়োজন হলে মানুষ প্রথমেই সন্ধানীর কাছে যায়। সন্ধানীর ব্যাপক কার্যক্রমের ফলে এখন শুধু মেডিকেল কলেজই নয় বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন রক্তদান সংগঠন গড়ে উঠেছে। মানুষ এক সময় রক্তদানকে ভীতিকর বিষয় মনে করে রক্ত দেয়ার সময় বলতো ‘রক্ত দেয়ার পর কতদিন বিছানায় থাকতে হবে’। তিনি সন্ধানী জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ইউনিটের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন এবং এটি দেশের একটি অনন্য ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সন্ধানী‘র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা সন্ধানী শুরু করে এবং তারাই প্রথমে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়। যে নিজের গায়ের রক্ত দিয়ে মানুষের সেবা করে সে মানুষের রক্ত ঝরাতে পারে না। সন্ধানীর শুধু রক্তদান ও চক্ষুদান কর্মসূচিই পালন করে না এর মাধ্যমে তারা মানবিক চিকিৎসক হয়ে রোগীকে দরদ দিয়ে সেবা দেবেন। তিনি বলেন, মানুষ সন্ধানীর নাম শুনলে শ্রদ্ধা করে। সেবামূলক কার্যক্রমে ব্যাপক অবদানের জন্য সন্ধানী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছে। যেখানেই দক্ষ ডাক্তার, দক্ষ পরিচালক দেখবেন, বুঝে নেবেন সে সন্ধানীর সৃষ্টি। তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বের সবদেশের চিকিৎসকরা তাদের দেশের লোকজন দ্বারা সমালোচিত। ভারতের, এমনকি ইংল্যান্ডের চিকিৎসকরাও তাদের মানুষ দ্বারা সমালোচিত। আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু আমাদের চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা কম। ফলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অধিক সময় দিতে পারেন না। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এমনভাবে বাঁচতে হবে, যেন মৃত্যুর মুখে বলতে পারেন আমার জীবন আমি উৎসর্গ করেছি এই পৃথিবীর সবচেয়ে মহৎ কাজ মানুষের মুক্তির জন্য। সন্ধানী’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডা. মোশারফ হোসেন মুক্ত বলেন, সন্ধানী সেবার মানসিকতা তৈরি করে। আমরা পেশাগত শিক্ষা লাভ করি, কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যে মানবিক শিক্ষার প্রয়োজন সেটা সন্ধানীর মাধ্যমে সম্ভব হয়। তিনি বলেন, সন্ধানীর নবীন প্রবীন সদস্যদের একত্রিত করতে সন্ধানীর ফাউন্ডেশন করা হচ্ছে। যারা মেডিকেলের পড়া শেষ করে চিকিৎসক হয়ে যাচ্ছেন তারা ফাউন্ডেশনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেবা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকতে পারবেন। সন্ধানীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সভাপতি ও সন্ধানী এলামনাই ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা, মনিলাল আইচ লিটু বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে মরণোত্তর চক্ষুদান অর্ডিন্যান্স করেন এবং তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে সন্ধানী ভবন নির্মাণে বিনামূল্যে জায়গা প্রদান করেন। তিনি বলেন, রক্তদান এখন আর সামাজিক এজেন্ডা নয়, এখন স্মার্ট সন্ধানী করার কথা ভাবা হচ্ছে। সড়ক নিরাপত্তা, স্থুলতা, সংক্রামক ও অসংক্রামক বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সন্ধানী কাজ করার কথা ভাবছে। সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের আয়োজনে ও সন্ধানী জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানের শুরুতে সকাল সাড়ে ১০টায় জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ মাঠে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সভার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন অতিথিবৃন্দ। পরে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত শেষে সন্ধানী সঙ্গীত এর সাথে সন্ধানী পতাকা উত্তোলন করা হয়। এসময় প্রতিটি ইউনিট নিজ নিজ ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন শেষে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। বিকেলে কেন্দ্রীয় সন্ধানী’র ষান্মাসিক সভা ও রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
উল্লেখ্য, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সন্ধানী ইউনিট পরিচালনায় ২য়। ২০০৪ সালে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে সন্ধানী ইউনিট এর আহবায়ক কমিটি গঠন ও এর কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত ২০০৬ সালে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে সন্ধানী’র ২৫তম কেন্দ্রীয় ষান্মাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।