জীবন থেকে নেয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৬:৩১ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
আব্দুল লতিফ শহরের এক সওদাগরী অফিসে চাকুরী করেন। সংসারে একমাত্র ছেলে রুস্তুম। রুস্তুম ছোটবেলা থেকেই শান্তশিষ্ট আর খুব মেধাবী। লতিফ রুস্তুমকে বিভাগীয় শহরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম থেকে ‘এ’ লেভেল পড়িয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য কানাডায় পাঠিয়েছেন। উদ্দেশ্য লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ কেননা শিক্ষা হচ্ছে যুবকের মাধুর্য, বৃদ্ধের সান্ত¦না, গরীবের ধন এবং ধনীর অলংকার, সর্বোপরি শিক্ষা হলো আত্মার চোখ। কিছুদিন আগে লতিফ তার এক বন্ধুর ছেলের মাধ্যমে রুস্তুমের প্রবাস জীবনের পরিবর্তন বিকাশের কথা জানতে পেরেছেন। লতিফ মনে মনে ভাবে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে কী ভুল করে ফেলেছেন? লতিফের কাছে মনে হয় পুত্রের কাছে পিতা একটি আচ্ছাদন। শিশু যখন অপরিচিত দুনিয়ায় একান্ত একা তখন সেই দুনিয়ার নিরুপায়ত্বের বিরুদ্ধে পিতা দেন ভরসা। ক্রমবর্ধমান জীবনে প্রয়োজন পড়ে বলিষ্ঠ সহচার্য। লতিফ কী সেই সহচার্য তাকে দিতে পেরেছেন? তিনি ভাবেন অধিক প্রত্যাশায় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে কী ভুল করেছেন?
আঃ লতিফ স্ত্রী আয়শার সাথে এতদবিষয়ে শেয়ার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভুল তথ্য যদি হয়ে থাকে তাহলে আয়শা কষ্ট পাবে, এই জন্য কথা বলা হয়নি।
ইত্যবসরে লতিফ চাকুরী থেকে অবসরে এসেছেন। সওদাগরী অফিস থেকে এককালীন টাকা যা পেয়েছিলেন তা থেকে উভয়ই দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেছেন। রুস্তুমের মা আয়শা বেগম হজ্জ থেকে ফিরে এসে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আচমকা না ফেরার দেশে অনেক স্বপ্নকে অপূর্ণ রেখে চলে গেলেন। রুস্তুমের মা চলে যাওয়াটা একদমই আচানক, ভাববার অবকাশ দেয়নি। আঃ লতিফ এখন নিঃসঙ্গ মানুষ। কাছে কেউ নেই না আছে ছেলে রুস্তুম না আয়শা। লতিফের জীবনটা ওলট পালট হয়ে পড়েছে। তিনি জীবনে বেঁচে থাকার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন। ইদানিং লতিফের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। প্রায়শই অসুস্থ থাকেন, কখনো কখনো তাঁর অসুস্থতা এতোই দীর্ঘতর হয় যে, বিছানায় লেপ্টে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। লতিফের শারীরিক কষ্টের কথা শুনতে রুস্তুম আগ্রহী নয়। একদিন উঁচু গলায় বলেই ফেলল, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার এনি অফ ইওর অবজেকশন’। লতিফের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। রুস্তুমের কথায় হতভম্ব হয়ে পড়েন লতিফ। রুস্তুম বলল কী? পৃথিবী থেকে গর্ভধারিণী মা চিরতরে হারিয়ে গেল অথচ বিমানের টিকেটের ব্যবস্থা করতে না পেরে শুধু ভার্চুয়ালি উহু আহু করে দায়িত্ব সেরে নিল।
রুস্তুম রুটিন মাফিক মাসে ২/১ বার ফোন দেয়। আজকাল রুস্তুমের মাঝে কোন দরদ নেই। তার মন মানসিকতা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কথার পিঠে কথা না জুড়িয়ে মুঠোফোনের লাইন কেটে দেয়। লতিফ ভাবেন যাকে অবর্ণনীয় ¯েœহ ও ভালোবাসায় বড় করে তুলেছি সেই কিনা আজ কথা বলার সময় পায় না। শুধু হাই-হুই করে ফোন ছেড়ে দেয়। লতিফের চোখের সামনে যেন একটা নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে গিয়েছে। লতিফের মনে প্রশ্ন জাগে রুস্তুম কি তার বৃদ্ধ পিতাকে কখনো দেখতে আসবে? সে কি কখনো ভাবে তার পিতা লতিফ কতটা নিঃসঙ্গতায় জীবনকে নিঃসঙ্গতার দহনে পার করছেন? কেন জানি আজকাল লতিফের মন সবসময় খারাপ থাকে। লতিফ ভালই বুঝতে পেরেছেন ছেলেটা আর আগের সেই রুস্তুম নয়। এভাবেই পথ চেয়ে চেয়ে তাঁকে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে হবে। লতিফ মনে মনে ভাবেন রুস্তুম এমন নির্দয় হলো কেমন করে। রুস্তুম কিভাবে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কথা বলতে পারল। নচিকেতার একটা গান ছিল বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কিত, এ গানটা লতিফ প্রায়শই শুনতেন। কিন্তু কখনো ভাবেননি যে তাকে একদিন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। রুস্তুমের এহেন স্বার্থপর কথা শুনে লতিফের বুকের পাঁজর ভেঙ্গে পড়লো, বুকের ভিতর হার্টবিট দ্রুততার সঙ্গে বাজতে শুরু করলো। রুস্তুম কি একটিবার ভাবে না তার বৃদ্ধ পিতা কতটা নিঃসঙ্গতায় জীবনকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে পার করছেন।
লতিফের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আসে। ছেলেটার সাথে কি তার কভু দেখা হবে না। সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছিল তার ভিতরের কষ্টটা ক্রমে আরো গভীরতর হয়ে আসছে। অন্য আর কারো সঙ্গেই শেয়ার করতে পারছেন না। কারণটা হলো রুস্তুমের মা আয়শা আজ বেঁচে নেই। যদি সে বেঁচে থাকতো তাহলে লতিফকে অ্যাবসোলিউটলি (অনংড়ষঁঃবষু) একা ভাবতে হতো না। লতিফ ইদানিং বিষণœ আর একাকী মর্ম যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন।
লতিফ বিষিয়ে ওঠা জীবন রথ নিয়ে চলতে পারছেন না নিজের অন্তরের শক্তি ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে। জীবনযুদ্ধে এই পরাজয়কে রুখে দেবার কোন শক্তি নেই। লতিফের অসুস্থতার খবর পেয়ে অনেকেই এসে বলছেন, আপনার তেমন কিছুই হয়নি। আমি অমুক… আমি তমুক চিনতে পারছেন? লতিফ চোখ বুজে পড়ে আছেন; নয়তো ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মন চায় ভালবাসায় প্রাণিত সেই স্পর্শ যা মুহূর্তে ঘোষণা করে, তুমি নিশ্চিত থাকো, তোমার দাম একটু কমেনি, লতিফ অষ্পষ্ট স্বরে মাঝে মাঝে বাকরুদ্ধ কন্ঠে বলেন বাবা রুস্তুম।
কাজের ছেলে আতিক ক্লান্তপ্রায়। প্রায় মাস ছয়েক গত হতে চলেছে পাড়া প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আসা-যাওয়া কমে গেছে। একদিন ল্যান্ডফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। লতিফ রিসিভার তুলেন। অপর প্রান্তে রুস্তুমের কন্ঠ- বাবা আমি আসছি। লতিফ ভাবেন রুস্তুম তাকে এতদিন পর করুণা করতে আসছে। রুস্তুমের আসার কথা শুনে তার ভিতরে কোন উচ্ছাস নেই। যে রুস্তুমের প্রতি এত ভালবাসা ছিল এখন তার প্রতি চরম ঘৃণা হচ্ছে। এক সময় লতিফের মনটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তবু পিতা-পুত্র রক্তের বাঁধন। তাকে বারণ করতে পারেনি। লতিফের মনে হলো রাত্রির প্রদীপ হলো চাঁদ, প্রভাতের প্রদীপ হলো সূর্য ধর্ম ত্রিভূবনের প্রদীপ, সৎপুত্র বংশের প্রদীপ। আপনজনই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
রুস্তুম লন্ডন থেকে বাংলাদেশ বিমানযোগে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একদিন সত্যি সত্যিই অবতরণ করলো। বিমানবন্দরের ফর্মালিটিজ শেষ করে সিএনজিযোগে এয়ারপোর্ট দিয়ে এগুচ্ছে। মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে একটি মৃত্যুসংবাদ। ঘোষক গলায় দরদ ঢেলে বার বার বলছেন, ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন। হবিপুর মহল্লার আব্দুল লতিফ সাহেব নিজ বাড়িতে গত রাত ৪ ঘটিকার সময় ইন্তেকাল করেছেন। মাইকের ঘোষণা শুনে রুস্তুমের মনটা আঁৎকে ওঠে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঘোষক তাঁর পাশ দিয়ে বার বার মৃত ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বাসার আঙ্গিনায় বাতাসের সাথে মিশে আসছে আতর নুবানের গন্ধ। চারিদিকে আগর বাতির ধোয়ায় ছেয়ে আছে। ঘরভর্তি মানুষের আনাগোনা। রুস্তুম জলভেজা চোখে দেখতে পেলো তারই জন্মদাতার নিষ্প্রাণ দেহ খাটিয়া পরে সাদা বসনে ঢাকা। কে যেন বলছিল আসলেই যখন বাবা উনি বেঁচে থাকতে আসলে তোমার বাবা স্বস্থির সাথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারতেন।