কফিশপে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৯:৩৯ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ আব্দুল হক
কফি শপে এক টেবিল ঘিরে চার তরুণ তরুণী। ওরা কথা বলছে, অস্থির। আমি পাশের টেবিলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে বসেছি মুখোমুখি। ইচ্ছে হলো কফি শপের আমাদের এই মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দী করি। পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছি। এক তরুণী এদিকে তাকাতেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকলাম। মেয়েটি এগিয়ে এলো। আমি আমার ক্যামেরাযুক্ত ফোনটি এক হাতে এগিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলাম, যদি কিছু মনে না-করেন ; আমাদের একটি ছবি তুলে দিতে পারবেন? মেয়েটি নম্র। হ্যাঁ আঙ্কেল, অবশ্যই এ কাজটি আমি করবো। আমার হাত থেকে বিনয়ের সাথে দুই হাতে মোবাইল ফোনটি নিলো। মেয়েটি ছবি তুলতে শুরু করেছে। এই সময়ে অন্য তিনজনও তাদের টেবিল ছেড়ে এসেছে আমাদের কাছাকাছি। এরপর আমার মোবাইল ফোন দিয়েই প্রত্যেকেই তাদের দক্ষতা দেখিয়ে ছবি তুলে দিলো।
ছবি তোলা শেষ হলে আমার মোবাইল ফোনটি খুবই বিনয়ের সাথে এক তরুণ আমার হাতে এগিয়ে দিলো।
আমি বললাম, আপনারা সবাই অনেক ভালো।
এক তরুণী বললো, আঙ্কেল আমাদেরকে তুমি করে বললেই আমাদের বেশি ভালো লাগবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সিলেট শহরে এতো জাঁকজমকপূর্ণ কফি শপ ছিলো না। কিন্তু আমরা বসে আছি, আর তোমরা দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা ঠিক না। যাও তোমরা বসে গল্প করো।
এক তরুণ বললো, আঙ্কেল অসুবিধা নাই। বরং ; আমরা কিছুক্ষণ আপনাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের মা-বাবা কখনো এভাবে কফি শপে আসেন না। আপনাদেরকে দেখে খুব ভালো লাগছে।
আমার স্ত্রী বললেন, মা-বাবারা নানান কাজ ও চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন। তোমরা কয়েকমাস পরপর নিজেরা নিজেদের মা-বাবার সঙ্গে কফি শপে কিংবা অন্য কোথাও ঘুরতে যেও।
আমি বললাম, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে তোমরা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পানির দিকে তাকিয়ে থাকবে এবং নদীর অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গাছ এবং উপরে আকাশে তাকিয়ে দেখবে। ভালো লাগবে তোমাদের।
এক তরুণ বললো, আঙ্কেল আমরা খুব অস্থির আছি। ইউনিভার্সিটির অনার্স শেষ বর্ষে পড়ালেখা করছি। এখন কেউ কেউ ভাবছি, এরপর দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা ও কাজ দুটোই করবো। কিন্তু নিজের পরিবার এবং দেশ ছেড়ে চলে গেলে যদি দেশের মানুষ আর আমাদেরকে না-চিনে? সেজন্যে কেউ কেউ পিছুটান অনুভব করছি।
আমি বললাম, পরিবার ও নিজের পূর্ব পুরুষের এলাকা ও দেশের প্রতি টান থাকা ভালো। এই টান তোমাদের ঠিকানা। যেখানেই যাও তোমরা শিকড়কে সাথে রাখো।
অস্থির হয়ো না। নিজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি মা-বাবা, চাচা, ফুপু, একান্ত আপন পরিবার এবং শিকড়ের খোঁজ সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। নিজেকে প্রকাশিত করো সুন্দর সংগ্রহ নিয়ে এবং বিকশিত হও। অস্থিরতা নয়, ধীরে। তোমার শিকড়, তোমার পূর্ব পুরুষের গ্রাম, তোমার দেশ পরিচিত হবে তোমার ঝলমলে বিকশিত সুন্দর জীবনের জয়গানে।
এরই মধ্যে কফি শপের এক স্মার্ট বয় আমাদের সকলের জন্যে কফি নিয়ে এসেছে। আমরা দুইজন বসে আর তরুণ তরুণী চারজন আমাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।
আমি আবার বলতে লাগলাম, দেখো, আমার ও আমাদের গ্রামের চাষি ভাই একখন্ড জমি পেয়ে সারাজীবন সেই জমিতে চষে বেড়ায় ফসল ফলায়। চাষি ভাই ফসল ফলায় খাদ্য উৎপাদন করে এবং সে নিজে খায় ও অন্যকে খাইয়ে তৃপ্তি পায়। তোমরা যারা শিক্ষার অধিক আলো পেয়েছো, জ্ঞান পেয়েছো, তোমরা মনে করো তোমাদের জন্যে রয়েছে চষে বেড়ানোর জন্যে এক পৃথিবী ভূখ-।
কফির পেয়ালায় এক চুমুক দিলাম। ওরা পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ নিলো।
গরম কফি, তাই, একটু অপেক্ষা।
আমি বললাম, শুনো হে তরুণ তরুণী, শিক্ষা অর্জন করো, হও ধ্যানী এবং জ্ঞানী। সারা পৃথিবী জুড়ে তোমার হবে অধিকার।
তুমি ছুটে চলো, তুমি থামো, তুমি মা-বাবা, পরিবার, পূর্ব পুরুষের সুন্দর পরিচয় কোমরে শক্ত করে বেধে সামনে চলো, তবে সামলে চলো। তুমি সারাজীবন কষ্ট করে সুন্দরের চর্চা করে যদি কোনো এক প্রান্তে থেকেও একবার আলো হয়ে উঠতে পারো, দেখতে পাবে তোমার এক জীবনের সফলতা সেখানেই।
আবার এক চুমুক কফির কাপে।
এক তরুণী বললো, আঙ্কেল, আপনি ধীরে ধীরে বলেন।
আমি বললাম, শুনো, কখনো বেতাল হয়ো না। তুমি যেখানেই থাকো অনুভবে পরিবার সাথে রাখো। দূরে থাকলে সময় করে পরিবারের আপনজনদের সাথে ফোনে কথা বলো। নিজের কাজ সাথে রাখো, বিশ্রাম সাথে রাখো, শিক্ষা ও জ্ঞান সাথে রাখো। জীবনে মাঝে মাঝে আনন্দ করো, তবে ; মাতাল হয়ো না। নৈতিক চরিত্র ঠিক থাকে যেনো। তাহলেই তুমি হবে পরিবার, গ্রাম, দেশ ও পৃথিবীর সুষমা। হ্যাঁ, সুষমা।
এক তরুণী জানতে চাইলো, আঙ্কেল, সুষমা অর্থ কী ?
সুষমা অর্থ হলো, সুন্দর শুদ্ধ মানুষ। এককথায় সুষমা।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেখলাম কফি অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই, আমরা আর কথা না-বলে কয়েক চুমুকে যার যার কফি শেষ করলাম।
আমি ও আমার স্ত্রী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
আমি বললাম, তোমরা ছবি তুলে দিয়েছো এবং এক চমৎকার পরিবেশ তৈরী করেছো। আমরা আনন্দ পেয়েছি। তোমাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এক তরুণ বললো, আঙ্কেল, আপনার কথা আমাদের মন কেড়েছে।
এক তরুণী বললো, আঙ্কেল, সত্যি সত্যিই আপনার কথাগুলো আমার মস্তিষ্কের নিউরনে ঢুকে গেছে।
আরেকজন আমার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললো, আন্টি আপনার কথা মনে থাকবে। অবশ্যই আমরা আমাদের মা-বাবাকে সাথে নিয়ে সময় করে ঘুরতে যাবো।
আমার স্ত্রী বললেন, আজকে এখানে আমাদের ছেলেরা আসতে বলেছে। সেজন্যেই এসেছি এবং তোমাদের সাথে দেখা হওয়ায় আরো বেশি ভালো লেগেছে।
এক তরুণ বললো, আপনারা ভালো থাকবেন।
আমি বললাম, আমরা এতোক্ষণ কথা বললাম, অথচ আমার পরিচয়টাও দিলাম না। তোমাদের পরিচয়ও জানা হলো না।
আমাদের পরিচয় হলো, আমরা শিক্ষার্থী। সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আর, আপনার পরিচয় আমরা জানি। দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় আপনার কবিতা, প্রবন্ধ এবং কলাম প্রায়ই পড়া হয় আমাদের।
তাই নাকি !
ঠিক আছে। তোমরা এখনই জীবন নিয়ে অধিক অস্থির হয়ো না। তোমাদের বয়স হয়তো এখন চব্বিশ কিংবা পঁচিশ হবে। দেখে নিয়ো, একসময় আমার মতো তোমাদেরও তিপ্পান্ন ছাড়িয়ে যাবে।
আসি এবার।