নতুন শিক্ষাক্রম ও ঘোড়া তত্ত্ব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪০:০৩ অপরাহ্ন
মো. ইউসুফ আলী
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুতেই বড় ধরনের হুঁচোট খেতে হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আঘাতসহ নানাবিধ অসঙ্গতির কারণে বই প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির একাধিক বই না পেয়েই ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। বছরের অর্ধেক সময় চলে গেছে কয়েকটি বই ছাড়াই। করোনা পরবর্তী শিক্ষার্থীরা আরেকটি ধাক্কা খেল। শিক্ষার্থীর ক্ষতির এ দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তায়। পাঠ্য পুস্তকের কেলেঙ্কারির সরকারকে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে। আওয়ামী সরকারের জন সমর্থন যে দিকগুলো নিম্নগামী, নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক কেলেংকারী অন্যতম। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে করোনা মহামারী কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ায় নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়েছে। সরকারের মেয়াদের শেষ বছর নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তাড়াহুড়া করতে যেয়ে বিতর্কিত ও ভুলে ভরা বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ আছে একজন শিক্ষাবিদের ব্যক্তিগত আদর্শ, দর্শন চরিতার্থ করার নিমিত্তে নতুন শিক্ষাক্রম! পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার পাঠ অন্তর্ভুক্তি করা সেই নীলনকশার অংশ হিসেবে অনেকে মনে করেন। শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০-৪০ এর বেশি হলে এ শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়।দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রতি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা এ সংখ্যার চেয়ে তিন চার গুণ বেশি। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানে একজন শিক্ষকের দৈনিক পিরিয়ড সংখ্যা ৩ ও বিষয় সংখ্যা ৩ এর বেশি হলে শিক্ষকের পক্ষে কোনভাবেই নতুন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে না। বাস্তবতা হলো একজন শিক্ষককে দৈনিক ৫-৭.টি পিরিয়ড ও বিষয়ে ক্লাস নিতে হয়।
শ্রেণি কক্ষের পরিবেশ তৈরি না করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার নামান্তর। এ শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীর জন্য যেসব কর্ম সম্পাদন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা পরিপালন করতে শিক্ষকের গলদঘর্ম অবস্থা। শিক্ষার্থীকে যে পরিমাণ ইনপুট দেওয়া হচ্ছে সে তুলনায় আউটপুট যৎসামান্য। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যাবে। যার খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে টিকে থাকা দায় হবে। মূল্যায়নে শিক্ষার্থী কৃত্বিতের যে নির্দেশক ব্যবহার করা হয়েছে তার বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি কতটুকু? শিক্ষার্থীর তার অর্জন কতটুকু তা যদি সে বুঝতে না পারে, তাকে বুঝতে না দেওয়া হয় তাহলে সে কিসের জন্য শিখবে? কোমলমতি শিশু কিশোররা তাদের অর্জিত যোগ্যতার পুরষ্কার পেলে তারা খুবই খুশি হয় এবং আরও ভালো করার জন্য মনোবল বৃদ্ধি করার প্রয়াস পায়।
নতুন শিক্ষাক্রমের বড় দুর্বলতা হলো মূল্যায়ন ব্যবস্থা।মূল্যায়নে যেখানে শিক্ষকদেরই ধারণা পরিষ্কার নয় সেখানে শিক্ষার্থীরা কতটুকু ধারণা পাবে? শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতা না থাকলে পরিশ্রমে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে। অলসতা তাদের গ্রাস করবে। জ্ঞান অর্জনে অনিহা আসবে, মেধা শূন্য হয়ে পড়বে জাতি। নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষায় ৪০ নম্বর বিদ্যালয় ভিত্তিক মূল্যায়ন এবং ৬০ নম্বরের পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রাথমিক থেকে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ৪০ এবং ৬০ নম্বরের অর্ধ বার্ষিক ও পরীক্ষা নিলে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে এবং জনগণের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তাও দূর হবে। শিরোনাম ঘোড়া তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেই ইতি টানব। অবশেষে বাতিল হলো পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ২০০৯ ও ২০১০ সাল থেকে। শুরু থেকেই ব্যাপক সমালোচনা করে আসছিলেন শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা। আওয়ামী সরকারের শুভাকাক্সক্ষী মহলও ইতিবাচক ভাবে নেয়নি এ পরীক্ষা দুইটি। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবাল সাহেব তো রীতিমতো এসব পরীক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন। এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের সাথে জাফর ইকবাল সাহেবের যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল তা বিভিন্ন পত্রিকায় জাফর ইকবাল সাহেবের কলাম থেকে স্পষ্ট। আরও স্পষ্ট হয়েছে নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের লেখা ‘লক্ষ্য অর্জনে যেতে হবে বহুদূর’ বই থেকে। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জোট সরকার সরে যাওয়ার পর এই দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাটা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়গুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সঠিকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। শিক্ষানীতি করা হয়েছিল, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল- সবমিলিয়ে দেশে শিক্ষা নিয়ে একটা উৎসবের ভাব ছিল।
তারপর ধীরে ধীরে কোথায় জানি এই গোলমালটা শুরু হয়েছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে পুরো লেখাপড়ার বিষয়টিতে একটা গোঁজামিল দেওয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে নেই তারপরও এদেশের ছেলেমেয়েদের ওপর জোর করে পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য দিনরাত সবার কাছে গালাগালি শুনি, ছোট ছোট শিশুর বাবা মায়েরা আমাকে অভিশাপ দেন। যদি এটা অনেক সুফল নিয়ে আসত তা হলে কেউ কিছু বলত না, সবাই মেনে নিত, কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি পরীক্ষার চাপে ছোট শিশুদের জীবনের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা সম্পর্কে তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের ভাষ্য হলো শিক্ষার মান বৃদ্ধি, দেশজুড়ে শিক্ষার সমতা অর্জন, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ব্যাপ্তি, সম্প্রসারণ ও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি কমানো আমাদের লক্ষ্য, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হচ্ছে, উৎসাহিত হচ্ছে। এছাড়া পরীক্ষা দুইটিকে তিনি উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ড. জাফর ইকবাল সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারণী সদস্য। অথচ একই বিষয়ে দুজনের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। যদিও নাহিদ সাহেব জাফর ইকবাল সাহেবকে শিক্ষা পরিবারের অন্যতম এবং একজন বড় মাপের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে তার পরামর্শকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাস্তবে তার পরামর্শকে আমলে না নিয়েই দুই মেয়াদে মন্ত্রীত্ব করে ৩য় মেয়াদে বাদ পড়েছেন। আওয়ামী সরকার ৩য় মেয়াদে ক্ষমতায় আসায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাফর ইকবাল সাহেবের প্রভাব দৃশ্যমান হয়। পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা বাতিল ও নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবক্তাই তিনি। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছা, আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয় কিনা ভাবার অবকাশ আছে! জাফর ইকবাল সাহেব উনার একটি লেখায় লিখেছিলেন, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির কিছু কিছু ঘোড়া (পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা) মরে গেছে, শুধু তাই নয়, মৃতদেহ থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব এগুলোকে করব দিতে হবে। পাঠকবৃন্দ, মরা ঘোড়ার পাশাপাশি জীবন্ত ঘোড়াগুলোকেও কবর দেওয়ার মাধ্যমে পুরো শিক্ষার কবর রচিত হয় কিনা- ভাবনার বিষয়!
লেখক : শিক্ষক।