বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৫৯:০৬ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
১৯৯৪ সালের বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি। তখন আমি এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলাম। তখন প্রত্যেক শিক্ষককে বাড়ি ভাড়া হিসেবে দেওয়া হতো ১০০ টাকা এবং চিকিৎসাভাতা দেওয়া হতো ২৫০ টাকা করে। আমি তখন সর্বমোট বেতন প্রতি মাসে পেতাম ১৩০০ টাকা। এই টাকাও প্রতি মাসে পাবার সম্ভাবনা ছিল না। এই টাকা পেতাম ২/৩ মাস পর। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বেসরকারি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল বেসরকারি শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করি।
প্রতিবারই দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও গ্রেড পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছেন। দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা হলো, মানুষ গড়ার কারিগর সেই শিক্ষকদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার এমনিতে দেওয়া হয় না, তাদেরকে দাবি আদায়ে, অধিকার আদায়ে মাঠে নামতে হয়, কঠোর আন্দোলন করতে হয়। তাঁদেরকে জলকামান খেতে হয়, লাঠিপেটা খেতে হয়, চরমভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। দেশ ও জাতির শিরতাজ সেই শিক্ষকদের এমন করুণ অবস্থা। জাতির জন্য লজ্জাকর আর কি হতে পারে? এর থেকেই শিক্ষকদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। সরকার ভালোভাবেই জানেন, শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার কী? কিরূপ বেতন ভাতা প্রদান করলে শিক্ষকগণ সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারলেও শিক্ষকদের দাবি ও অধিকারের প্রতি সরকারের সকল অনীহা। শিক্ষকদের বাদ দিয়ে কি উন্নত দেশ ও জাতি আশা করা যায়? তাহলে শিক্ষকদের প্রতি এত অনীহা কেন?
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকেরা একই পাঠ্যক্রমে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ান। কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধায় বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা বর্তমানে মূল বেতন পুরোটাই পান। আগে পেতেন ৮০ শতাংশ। কিন্তু বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার ক্ষেত্রে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সরকারি শিক্ষকেরা মূল বেতনের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পান বাড়ি ভাড়া এবং উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের সমান। তারা চিকিৎসা ভাতা পান ১৫০০ টাকা। পক্ষান্তরে বেসরকারি শিক্ষকেরা মাত্র ১০০০ টাকা পান বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫% এবং চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৫০০ টাকা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একজন বেসরকারি শিক্ষকের যদি মূল বেতন হয় ১২ হাজার টাকা। তিনি ২৫% হারে উৎসব ভাতা পাবেন মাত্র ৩ হাজার টাকা। এই ৩ হাজার টাকায় ওই বেসরকারি শিক্ষক তাঁর পরিবারকে নিয়ে কি কোনো উৎসব পালন করতে পারবেন? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে তা কি কোনোক্রমেই সম্ভব? না, তা কখনও সম্ভব নয়। মোট কথা, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা যে বেতন ভাতা পান তা দিয়ে কোনোক্রমেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির এ যুগে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। শিক্ষকেরা যেখানে কিভাবে ক্লাসে সুন্দর পাঠদান করবেন সেই চিন্তায় মগ্ন থাকার কথা সেখানে সেই শিক্ষকদেরকে আর্থিক চিন্তায় বিভোর থাকতে হয় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। আর্থিক চিন্তায় বিভোর থেকে সেই শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে কিভাবে সুষ্ঠু ও মানসম্মত পাঠদান করেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্যই বেসরকারি শিক্ষকদের এই আন্দোলন। তারা আন্দোলন শুরু করেন ১১ জুলাই ২০২৩ থেকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শিক্ষক ঢাকায় এসে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন শ্রাবণ মাসের চড়া রোদ উপেক্ষা করে। শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসার যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম করছেন, তখন মানুষ গড়ার কারিগর বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরা রাস্তায় মশার কামড় খাচ্ছেন। এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই ২০২৩ আন্দোলনরত শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। শিক্ষকেরা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানান। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে বেসরকারি শিক্ষকেরা ১৫ দিন অনশন করেছিলেন। তখনও শিক্ষকদেরকে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়করণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে’।
এবার শিক্ষকেরা ইস্পাত কঠিন সংকল্প নিয়ে মাঠে নামেন। এবার (২০২৩) তারা ১১ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন করেছেন। এবারে তাঁরা কফিনের কাপড়ও পরেছেন। অবশেষে শিক্ষকদের কাছে ছুটে আসেন শিক্ষা উপমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা করলেন, শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করা হবে।’ শিক্ষকেরা আপাতত খুশি হন, তাঁরা আন্দোলন ছেড়ে ২ আগস্ট ২০২৩ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান।
শিক্ষকেরা যে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের দাবি করেছেন, তার যৌক্তিকতা ও সরকারের সক্ষমতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবিটি যে শতভাগ যৌক্তিক, তা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে সরকারের যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন, সেটি জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে বেশি নয়। আগে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন করে পরে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করতে হবে। কারণ মেধাবী জনশক্তি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক থেকেই তৈরি করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে মেধাহীন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কোনো লাভ নেই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সকল স্তরের শিক্ষকদের বেতন অত্যন্ত কম। এটাই শিক্ষার উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। শিক্ষকদের সকল দাবি মেনে নিয়ে অবিলম্বে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা সরকারের মহান দায়িত্ব।
লেখক : কলামিস্ট।