জানা অজানা: সৈয়দ মুজতবা আলী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১:৪৩:৩০ অপরাহ্ন
মিলু কাশেম
বাংলাদেশের জন্মের বহু বছর আগেই বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি আমাদের সিলেটের সন্তান সৈয়দ মুজতবা আলী। উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে, একথা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা বাঙালি নেতাদেরও মাথায় ছিল না। কিন্তু ছিল আমাদের সিলেটের সন্তান বহু ভাষাবিদ পন্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাবনায়। যিনি পাকিস্তান জন্মের ১০৫ দিন পরে এই সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। সেদিন ছিল ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর রবিবার ।
দেশভাগের মধ্য দিয়ে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সদ্য পূর্ব পাকিস্তানে সংযুক্ত হওয়া শ্রীহট্রের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে সংসদের সৈয়দ আবদুল মজিদ হলে (পরবর্তীতে জিন্নাহ হল, বর্তমানে শহীদ সোলেমান হল) আয়োজন করা হয় এক সুধী সমাবেশের। এই সভায় মূল আলোচক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। আলোচনার বিষয় ছিল – পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু হওয়া উচিত। সৈয়দ মুজতবা আলী সে দিনের সেই আলোচনায় বলেছিলেন-উর্দুকে যদি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা করা হয় তবে এর ভবিষ্যত কখনো ভাল হবে না। বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হলে একদিন আমাদের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। এবং তার পরিণতিতে একদিন এই দেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বক্তব্য পরবর্তীতে শ্রীহট্রের মাসিক ‘আল ইসলাহ’ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী তখন থেকেই পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর রোষাণলে পড়েন। যার পরিণতিতে ১৯৪৯ সালে ভারতীয় চর অপবাদ নিয়ে তাকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি অনবদ্য গ্রন্থ রয়েছে যার নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। বাংলাদেশের জন্মের ২৪ বছর আগে আমাদের সিলেটের সন্তান সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই ভবিষ্যত বাণী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি বাহিরে বের হতেন বিদেশ যেতেন তখন তাকে মনে হতো ইউরোপীয়ান। তার গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল। একবার তিনি কলকাতা নিউ মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছিলেন,তখন এক ভদ্র মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করলেন আর ইউ অ্যান আমেরিকান? তিনি বললেন নো। আর ইউ অ্যান ইউরোপিয়ান? তিনি আবার বললেন নো। তৃতীয় বার প্রশ্ন করার আগেই সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন, ম্যাডাম আপনি কি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম শুনেছেন? সচকিত ভদ্রমহিলা ভীষণ বিড়ম্বনায় পড়ে বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমিই সৈয়দ মুজতবা আলী। ভদ্রমহিলা তো বিস্ময়ে হতবাক। তার পর আরও বিস্ময়ে ভেঙে পড়ার আগেই সৈয়দ মুজতবা আলী সেখান থেকে সটকে পড়লেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শান্তিনিকেতনের নির্মল পরিবেশে সে সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার প্রথম দেখা ১৯১৯ সালের নভেম্বরে সিলেটে। ঐ সময় রবীন্দ্রনাথ সিলেট পরিভ্রমণ কালে সিলেটের এম সি কলেজে ‘আকাক্সক্ষা’ বিষয়ক বক্তৃতা করেন। সেই অনুষ্ঠানে মুজতবা আলী একনিষ্ঠ শ্রোতা। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা তার মনে গভীর উন্মাদনার সঞ্চার করে। আকাক্সক্ষা কিভাবে বৃদ্ধি করতে হয় সে বিষয়ে গুরুদেবকে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় একটি চিঠি লিখেন মুজতবা। কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জবাব এলো- ‘তোমার অন্তরের সুদূর ইচ্ছাই তোমাকে তোমার পথ দেখিয়ে দিবে।’
গুরুদেবের সেই চিঠি সৈয়দ মুজতবা আলীর মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। যে প্রভাব তার পিতার অনুমতি সাপেক্ষে তাকে শান্তিনিকেতনের পথ দেখালো। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী যখন শান্তিনিকেতনে পা রাখলেন তখনো তার মুখে সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার টান। প্রথম দিন গুরুদেব মুজতবার কথা শুনে বলেছিলেন ‘তোর মুখেতো এখনো কমলালেবুর ঘ্রাণ আছেরে’। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কথা তিনি বিভিন্ন আড্ডায় বলতেন। তার বিভিন্ন লেখাতেও সে কথা এসেছে বারবার।
১৯২১ সাল। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং ১৯২৬ সালে সেখানে পাঁচ বছর পড়ার পর তিনি বিশ্ব ভারতীর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। শান্তিনিকেতনে মুজতবা কবিগুরুর বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। তার পর ‘হুমবল্ট’ বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করতে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন জার্মানিতে। সেখানে হুমবল্ট ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনে ও রাইনিসে ফ্রেডরিচ উইলিয়াম ইউনিভার্সিটি অব বনে দর্শন শাস্ত্রে তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। ১৯৩২ সালে মুজতবা আলী বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি পিএইচডি করতেন সেই সময়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। একবার বন শহরে এক কৌতুক প্রতিযোগিতার আয়োজন হল । স্থানীয় জার্মান ভাষায়। আর সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। যা অকল্পনীয়।
একবার এক রাষ্ট্রদূত তাঁর সাথে সাক্ষাত করে আলাপ করলেন। পরে সেই রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে এত অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এত বিষয়ে আলাপ শুনি নাই, যেটা উনি আমাকে শুনিয়েছিলেন অল্প কয়েক ঘন্টার মধ্যে।’
১৭টি ভাষা ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর দখলে। এই সব ভাষাতেই তিনি কথা থেকে শুরু করে লিখতে পর্যন্ত পারতেন। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ‘গীতা’ ছিল তার সম্পূর্ণ মুখস্থ। কবিগুরুর ‘গীতবিতান’ শেষ থেকে শুরু পর্যন্ত ছিল তার সম্পূর্ণ মুখস্থ। একবার এক অনুষ্ঠানে এক পুরোহিত সংস্কৃত ভাষায় গীতা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখছিলেন। উনি ধরে ফেললেন কিছু জায়গায় ভুল বলেছেন ওই পুরোহিত। দাঁড়িয়ে সমস্ত বক্তব্য মূল সংস্কৃত ভাষায় কি হবে তা মুখস্থ বলে গেলেন। উপস্থিত দর্শকেরা হতবাক। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনা করেছিলেন। সেই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবার পূর্বে বলেছিল, ‘আমার অভিধান যদি কোনো সময় সংশোধন করার প্রয়োজন হয় তাহলে যেন সৈয়দ মুজতবা আলী সেটা করে।’ এর মাধ্যমেই বোঝা যায় সৈয়দ মুজতবা আলী-র বাংলা ভাষায় কত গভীর দখল ছিল।
আদ্যন্ত ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। জাত ধর্ম নয়। মনুষ্যত্বের শিক্ষাই ছিল তাঁর আদর্শ। কটাক্ষের শিকার হতেন প্রায়ই। অনেকেই বলত, ‘মুজতবা আলীর ধর্ম নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গি একটা আইওয়াশ, আসলে আলী একজন ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট। আক্ষেপ করে তিনি লেখক শংকরকে বলেছিলেন, ‘এক একটা লোক থাকে যে সব জায়গায় ছন্দপতন ঘটায়, আমি বোধহয় সেই রকম লোক। রসবোধ ছিল তার খুব বেশি। তাই রস সাহিত্যিক হিসাবেও তার খ্যাতি রয়েছে।
মৃত্যুর আগে অবধিও তার রসবোধ বজায় ছিল। বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর সবাইকে বলবে আলী সাহেব তার বেস্ট বইটা লেখার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু কী করবেন, উনার তো প্যারালাইসিস হয়ে ডান হাতটা অবশ হয়ে গেল। হাতটা ভালো থাকলে তিনি দেখিয়ে দিতেন সৈয়দ মুজতবা আলীর বেস্ট বই কাকে বলে।’ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত বইয়ের সংখ্যা ত্রিশ। তাঁর লেখা পড়লে অনুধাবন করা যায় তাঁর লেখনীর গভীরতা, তাঁর জীবনতৃষ্ণার প্রতি ভালবাসা। সৈয়দ মুজতবা আলী-র মত সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল। সাহিত্যে তার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৫০ সালে তিনি নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ সালে কলকাতায় তাকে আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের আসামের শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জে। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান ত্যাগের পর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে তার কলকাতায়। বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় ফিরেন। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৭০ বছর বয়সে ঢাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে ভাষা শহীদ বরকত সালামের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
কিংবদন্তি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর আজ ১১৯ তম জন্মদিন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা এই কীর্তিমান বাঙালির প্রতি।
লেখক : কবি।