ফলোআপ: নিয়োগ বাণিজ্য
পরিবার পরিকল্পনার ডাঃ জেসমিনকে গ্রেফতারে মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় সিআইডি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮:৪৯:০২ অপরাহ্ন
আটক বরুণ ছত্রীর আদালতে স্বীকারোক্তি, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে একজন
নূর আহমদ
শিগগিরই গ্রেফতার হচ্ছেন জনবল নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিন। এরই মধ্যে তার অন্যতম সহযোগী বরুণ ছত্রী নামের পরিবার পরিকল্পনা সহকারীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তাকেও (ডা: জেসমিন) গ্রেফতারের অনুমতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা। অনুমতি পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। অপরদিকে, গ্রেফতার হওয়া বরুণ ছত্রী নিজে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জবানবন্দিতে তার নির্দেশদাতা ও মূলহোতা হিসেবে ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনের কথা উল্লেখ করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া পঞ্চম দাশ নামের এক পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পালিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে চাকুরিরতরা আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
চলতি বছরের গত ২২ মার্চ ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়েও নিয়োগ পেলেন ৯ পরিবার কল্যাণ সহকারী’ শিরোনামে-দৈনিক সিলেটের ডাক-এ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি সিলেট তথা পুরো স্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে। এরপর ডিপার্টমেন্ট (বিভাগীয়) তদন্ত করে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে চাকুরিরত ৮ জনকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে থানায় মামলা করেছিলো। আর জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন এর বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ চলমান রয়েছে। এর অংশ হিসেবে তাকে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যার স্মারক নং ৫৯.০০.০০০০.১১০.৯৯.০০২.২৩-২১৯। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিরুদ্ধে আনীত জেলা পর্যায়ের নিয়োগে এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনিভাবে এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে জেলা নিয়োগ ও বাছাই কমিটির সুপারিশ বহির্ভূত ৮ জনের অনুকূলে নিয়োগপত্র জারি সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিভাগীয় মামলা তদন্তের স্বার্থে তাকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন এই প্রজ্ঞাপন জারি করেন।’
অপর একটি স্মারকে (৫৯.০০.০০০০.১১০.৯৯.০০২.২৩-২২০) ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শৃঙ্খলামূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া আরো একটি স্মারকে (৫৯.০০.০০০০.১১০.৯৯.০০২.২৩-২২১) পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সিলেটের জেলা প্রশাসক তথা নিয়োগ কমিটির সভাপতিকে জনবল নিয়োগ ও বাছাই কমিটির সুপারিশ বহির্ভূতভাবে নিয়োগকৃত ৮ জন ব্যক্তির নিয়োগপত্র বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বর্ণিত কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়েরের নির্দেশ দেয়া হয়।
অন্য আদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। (৫৯.০০.০০০০.১১০.৯৯.০০২.২৩-২২) নং স্মারকে তদন্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিন যেন বিদেশে পলায়ন করতে না পারেন-এজন্য তাঁর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশ দেয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে।
অপরদিকে, এয়ারপোর্ট থানায় দায়ের করা মামলা নং ১৯ (২৭/০৩/২০২৩)। এজাহারভুক্ত আসামী হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ জনকে আসামী করা হয়। তবে ৮ জন আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
অপরদিকে, ঘটনার মাস দুয়েক পর মামলাটি অধিকতর তদন্তের স্বার্থে সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সিআইডির সাব ইন্সপেক্টর রিপন কুমার দে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন। অভিযোগ রয়েছে, মামলাটি পুলিশে থাকাকালে রহস্যজনকভাবে ভিন্ন ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পরে সিআইডিতে ফিরে আসার পর মামলাটিতে গতি আসে। গত ১৭ আগস্ট সিআইডি জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের পরিবার পরিকল্পনা সহকারী বরুণ ছত্রীকে গ্রেফতার করে। এরপর বরুণ আদালতে নিজেকে জড়িয়ে এবং ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন তার নির্দেশদাতা ও মূলহোতা উল্লেখ করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এরপর সিআইডি ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনকে গ্রেফতারের অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
এ ব্যাপারে সিআইডির সাব ইন্সপেক্টর রিপন কুমার দে বলেন, বরুণ ছত্রী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তার সাথে সম্পৃক্তদের নামও বলেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম বলা যাবে না।
অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে সিআইডি ওসমানীনগরের সদ্য অবসরে যাওয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিতোষ মজুমদার ও দক্ষিণ সুরমার সহকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানদা রঞ্জন দাসকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এরই মধ্যে মহিতোষ মজুমদারের সহযোগী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পঞ্চম দাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, সে বিদেশে পালিয়েছে। দক্ষিণ সুরমা পরিবার পরিকল্পনা অফিসে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানদা রঞ্জন দাসের সহকারী শংকর দাশকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। ধরাছোয়ার বাইরে ছিলেন এমন অনেকেরই নাম যুক্ত হওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
মামলার বাদী বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, সিলেট এর সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল মনসুর আসজাদ বলেন, মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। শুনেছি এজাহারভুক্ত আসামীরা জামিনে রয়েছেন। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া বরুণ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরচেয়ে বেশি তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, বরুণ ছত্রী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও তাকে এখনো পর্যন্ত বরাখাস্ত করা হয়নি। সূত্র দাবি করছে, জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা সম পদমার্যাদার একটি চক্র বরুণকে বরখাস্ত না করতে নানাভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চাপ সৃষ্টি করছে। এজন্য গ্রেফতারের পরও তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। এছাড়া, নিয়োগে বরুণ ছত্রীর স্ত্রী রীতা নায়েক আয়া পদে চাকুরি পেয়েছিলেন। ওই চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিন গ্রেফতার হওয়ার বরুণকে দিয়েই নানা অপকর্ম সম্পাদন করেন। আবার অভিযোগ উঠেছে শক্তিশালী ওই চক্র বরুণের উপর দায় চাপিয়ে নিজেরাই পার পেতে মরিয়া রয়েছেন।
এ ব্যাপারে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক ডাঃ বিপ্লব বড়–য়া বলেন, বরুণ ছত্রীকে সিআইডি গ্রেফতার করেছে। সে বর্তমানে কারাগারেই রয়েছে। একই সাথে ওসমানীনগরের পঞ্চম দাশ নামের একজন পরিবার পরিকল্পনা সহকারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন বলে জানান। তবে বরুণকে কেন বরখাস্ত করা হচ্ছে না জানতে চাইলে ডাঃ বিপ্লব বড়–য়া বলেন, নিয়োগকারী কর্মকর্তা হচ্ছেন পরিচালক। আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো: কুতুব উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্তনাধীন বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই না। বরুণকে বরখাস্তের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু বিধি বিধান রয়েছে। আমরা সেটা ঘেঁটে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।