সুন্দর মিয়ার দোকানে তালা এবং..
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২:৩৯:২৪ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী
প্রায় দুই দশক আগের কথা। ভাটির জনপদ দিরাই। মফস্বল শহর। তেমন চাকচিক্য নেই। নেই উন্নত রাস্তাঘাট। কিন্তু ভরদুপুরে হকার রবি বর্মনের দোকানে যখন পত্রিকার বান্ডিল আসত, হুমড়ি খেয়ে পড়তেন পাঠকরা। সংবাদপত্রের সেই স্বর্ণযুগে আমার সাংবাদিকতা শুরু। জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক থেকে আঞ্চলিক শীর্ষ পত্রিকা দৈনিক সিলেটের ডাকের কাটতির শেষ নেই। এক সাপ্তাহিকের মধ্য দিয়ে অনেকটা শখের বশে এ জগতে আসা। তখন ২০০৪ সাল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। সরগরম পত্রিকার পাতা। বলা যায় সেই সংবাদ লেখার মধ্য দিয়েই শুরু। এরপর দিরাইর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কত ঘুরে বেড়িয়েছি সংবাদের জন্য- একটি ভালো ছবির জন্যে।
দিরাইজুড়ে হুলুস্থুল কান্ড। মদে ইথানল মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। এর ফলে মাদকাসক্তদের অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত। সুনামগঞ্জ বার্তায় টিপু সুলতান ভাইর এমন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হুলুস্থুল পড়ে যায়। টিপু ভাইর রিপোর্ট মানেই তোলপাড়। তখন তিনি দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধি। আর ইত্তেফাকের প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান তালুকদার, আমার প্রিয় হাবিব ভাই। হাওরাঞ্চলের দুঃখ-দুর্দশার সচিত্র প্রতিবেদন উঠে আসত হাবিব ভাইর প্রতিবেদনে। আজকের কাগজে শেখ কবির আহমেদ আর জিয়াউর রহমান লিটন ভাই দৈনিক খবরপত্রের দিরাই উপজেলা প্রতিনিধি। শাহজাহান মাহমুদ হেলাল, শামসুল ইসলাম খেজুর, মাসুক সর্দারও তখন সক্রিয় সাংবাদিক। আর আজকের দেশব্যাপী সুপরিচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক নেসারুল হক খোকন ভাই সবেমাত্র দিরাই ছেড়ে রাজধানীতে শিফট হয়েছেন। যোগ দিয়েছেন বাংলাবাজার পত্রিকায়। এর আগে দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক সিলেটের ডাকের দিরাই উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
যেহেতু অচেনা এই জগতে একেবারে নতুুন, তাই আমার আগ্রহেরও কোনো কমতি নেই। তখন দৈনিক আমার দেশ ও নয়াদিগন্ত বাজারে আসছে আসছে ভাব। অনেক বোঝাপড়ার পর আমি নয়াদিগন্তে আর এম. আর মিজান মানে রুদ্র মিজান আমার দেশের প্রতিনিধি হলাম। শুরু হল আমারও সক্রিয় সাংবাদিকতা। এবার শখ থেকে পুরোদস্তুর পেশাদার সাংবাদিক। আমাদের সাথে যুক্ত হলেন এস. এম সুহেল। সুহেল হলেন সিলেটের প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক যুগভেরীর প্রতিনিধি। সুহেল এখন ইউরোপের দেশ পর্তুগাল প্রবাসী। আমি, মিজান আর সুহেল এই তিনজনের জোট আমাদের। সিনিয়রদের বাইরে বলা যায় নিজস্বতা বজায় রেখে আমরা চলতে থাকলাম। কিন্তু দিন শেষে সন্ধ্যায় সবাই একই জায়গায় গিয়ে বসতাম। সেটা ছিল দিরাই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ফজলুল করিম খান ভাইর ওখানে।
আজকের এই ডিজিটাল সময় তখন ছিল না। নিজস্ব রিপোর্ট সাদা কাগজে লিখে ছবিসহ কুরিয়ার সার্ভিসে পত্রিকার মফস্বল সম্পাদকের নিকট পাঠানো হতো। জরুরি কোনো নিউজ থাকলে টেলিফোনে জেলা প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান পীর ভাইর নিকট পাঠাতাম। পীর মাহবুব ভাই এখন যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি।
সুনামগঞ্জে পাঠানো নিউজ আবার উজ্জ্বল মেহেদী ভাই, খলিল রহমান ভাই, মহিম ভাই ও পীর ভাই শেয়ার করতেন। নয়া দিগন্তে এক সময় আমার প্রায় নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকল। এমন সময় দিরাইয়ে পোস্টিং হলেন আলম সরকার নামক এক ওসি। আলম সরকার নরসিংদীর বাসিন্দা। দাড়ি বা গোফ তার নেই। কিন্তু মাথায় টুপি থাকত সারাক্ষণ। কথায় কথায় বলতেন তিনি তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূইয়ার ভাগনা। গুনগুন করে গাইতেন পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। তার দাপট, অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হন অনেকে। সাংবাদিকদের মধ্যে প্রথমেই টিপু ভাইকে সে শিকার করে। সম্পূর্ণ মিথ্যা একটা মামলার আসামি হয়ে কারাগারে যান টিপু ভাই। লন্ডনী নিজঘরের কাজের মেয়ের সাথে অঘটন ঘটিয়েছে, এমন একটি সত্য রিপোর্ট কাল হয়ে দাঁড়ায় তার। টিপু ভাইর পরই আলম সরকারের টার্গেটের শিকার হলাম আমি। আমাদের সম্পত্তি নিয়ে গ্রামের একজনের সাথে বিরোধ দেখা দিল। যেহেতু পারিবারিকভাবে আমাদের সবাই আওয়ামী লীগ, তাই বিএনপির কর্মী লোকটি নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদে একের পর এক মামলা করতে থাকল। অন্তত ১২ মামলার এজাহারে নাম ছিল আমার। শেষ পর্যন্ত ওসির দাপট আমাকে কাবু করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান লিটন ভাইর সামনে সে একদিন এজন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। সকলের সিনিয়র সাংবাদিক হাবিব ভাইসহ মোটামুটি সকল সাংবাদিক ওসি আলম সরকারের ওপর কোনো না কোনোভাবে ক্ষুদ্ধ ছিলেন। ক্ষমতার দাপটে সে ছিল বেপরোয়া। রাতে থানায় মাদকের আসর বসাতো, এমনি সুন্দরী রমণীদেরও নিয়ে আসত।
একদিন রাতের বেলা থানা পয়েন্টে নগদীপুরের সুন্দর মিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ অশ্রুসজল।
ঘটনা কী, বিএনপি পাগল লোকটা অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন! কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি পুরো ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। নগদীপুর বাজারে তার মালিকানাধীন একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার পুত্র দোকানটি পরিচালনা করেন। মালামালে দোকানটি ঠাঁসা। হঠাৎ করে থানার পুলিশ আদালতের কোনো আদেশ বা কোনো কারণ ছাড়াই সুন্দর মিয়ার দোকানটি তালা মেরে দেয়। বর্ষার প্রচন্ড ঢেউ মাড়িয়ে ওসির সাথে এসে দেখা করলেন। আলাপ আলোচনা শেষে ওসি ১০ লাখ টাকা দাবী করে বসল। অশ্লীল গালিগালাজও করল। আর যায় কোথায় ওসির বাহাদুরি। রাতেই সুন্দর মিয়া সুনামগঞ্জ ছুটে গেলেন। আইনজীবী মামলা রেডি করলেন। ওসির বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় সুনামগঞ্জ আদালতে মামলা দায়ের করা হল। একই দিন সিলেটের ডিআইজি, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নিকট লিখিত অভিযোগও দিলেন সুন্দর মিয়া।
পরদিন শুধুমাত্র আজকের কাগজ ছাড়া সকল পত্রিকায় ছাপা হল ‘১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় দিরাইর ওসির বিরুদ্ধে মামলা’। মাত্র একদিনের ব্যবধানে তার বাহাদুরি শেষ। হাবিব ভাই, টিপু ভাই, লিটন ভাই, ইয়াহইয়া ভাইসহ আমরা গস্তি নৌকায় করে সরেজমিনে নগদীপুর বাজারে গিয়েছিলাম। ওসি সে সময় সকল সাংবাদিকের মোবাইলে কতবার কল দিয়েছিল, তার হিসেব নেই। কিন্তু সেদিন কেউ তার কল রিসিভ করেননি। তার চোখ দিয়েও কম অশ্রু ঝরেনি। পরে শুনেছি সিলেট হয়ে নয়, হবিগঞ্জের বানিয়াচং হয়ে নাকি দিরাই ছেড়েছিলেন ওসি আলম।
আমার বড় চাচা সুনামগঞ্জে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী, দিরাই সরকারি কলেজ ও তাড়ল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জননেতা সুজাত আহমেদ চৌধুরী ওসির মামলাসহ পুরো ঘটনা জানতে চাইলেন। বিস্তারিত শোনার পর তিনি বলেছিলেন, ওসির আসলে সাংবাদিক বা সংবাদপত্র সম্পর্কে ধারণা নেই। না হয় সাংবাদিকদেরকে এভাবে হয়রানি করত না। এরপর সুন্দর মিয়া বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
সে সময় আজকের মত এত পত্রিকা ছিল না। আর আজকে যেভাবে ডটকমের নামে অপসাংবাদিকতা চলছে, তা কল্পনাও করা যায়নি। একসময় ২০০৫ সালের জুলাই মাসে সিলেট অঞ্চলের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাকে আমার ডাক পড়ল। ১০ জুলাই যোগদান করলাম সিলেটের ডাকে। সেই থেকে টানা দেড় যুগ বা ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। দিরাই ছেড়ে সিলেটে চলছে আমার সাংবাদিকতা। কিন্তু দিরাইর সেই সামান্য দিনগুলো এখনো আন্দোলিত করে। মনে পড়ে সেই দিনগুলো। আজ উৎসবমুখর পরিবেশে দিরাই প্রেসক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু এই আনন্দের দিনে আমাদের প্রিয় সহকর্মী, প্রিয় বড় ভাই হাবিবুর রহমান তালুকদার ও টিপু সুলতান আর আমদের সাথে নেই। তাদের কাছ থেকেও কম শেখা হয়নি। কম সহযোগিতা করেননি জিয়াউর রহমান লিটন ও শেখ কবির আহমেদ। আজও মনে হয় সাংবাদিকতার শেখার এবং জানার শেষ নেই। কেবল শেখার জন্যে এখনো সিলেটে সাংবাদিকতা বিষয়ক নানা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। সাংবাদিক আসলে সুন্দর চেহারা বা খুব সুঠাম দেহের অধিকারী হলেই হওয়া যায়না। পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনের পর্দা প্রমাণ করবে তিনি আসলে কেমন সাংবাদিক। তাই পেশা হিসেবে সাংবাদিকতায় আসতে হলে অবশ্যই পড়ালেখা করে আসতে হবে।
লেখক : কোষাধ্যক্ষ সিলেট প্রেসক্লাব; সভাপতি, তাড়ল উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, দিরাই।