‘বিচ্ছিরি রকমের গরীব’দের বংশবৃদ্ধি ঠেকাতেই হবে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৪০:২৫ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সাহেবের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হবার সৌভাগ্য আমার হয়। তখন একবার লেখালেখি প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘দাদা, যেকোন রকমের লেখালেখি কিন্তু আসলে সত্যিকার অর্থেই পাঠক সমাজের প্রতি এক প্রকার নিবেদন।’ যেকোন লেখকের এই নিবেদন সম্মানিত পাঠক সমাজের হৃদয় স্পর্শ করতে পারলেই লেখকের যতো স্বার্থকতা। আমার আজকের নিবেদন শুরু করছি, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উক্তি দিয়ে।
উক্তিটি হলো, ‘লোকটা গরীব। খুবই গরীব।’ কি রকম এবং কতটা গরীব বলুন তো মশাই। বিচ্ছিরি রকমের গরীব। আসলে টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই।’ এখানে যে রকমের গরীবের কথা বলা হয়েছে তা সবসময়, সব ক্ষেত্রে, সবার বেলায় সত্য নাও হতে পারে। ব্যতিক্রম সব ধরনের সূত্রের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। টাকা থাকলেই অনেককে বিচ্ছিরি রকমের গরীব বলা যাবে না। টাকা থাকলেও অনেককে অনেক কিছুর অধিকারী হতে দেখা যায়। তবে সেটা খুবই বিরল ঘটনা মাত্র। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। কারণ ঐসব গরীবদের দ্বারা সমাজের কোন হিত সাধন হতে দেখা যায় না। অন্তরদৃষ্টি নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বহু বছর আগেই বিষয়টি দেখেছেন এবং অবিভক্ত ভারতের যুবকদের সে ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। যুব সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলে গেছেন- ‘হে বীর হৃদয় যুবকবৃন্দ…. আর কিছুতেই আবশ্যক নেই, আবশ্যক শুধু প্রেম, সরলতা ও সহিষ্ণুতা।… হে যুবকবৃন্দ দরিদ্র অজ্ঞ ও নিপীড়িত মানুষের ব্যথা তোমরা প্রাণে প্রাণে অনুভব কর, সেই অনুভবের বেদনায় তোমাদের হৃদয় রুদ্ধ হোক, মস্তিষ্ক ঘুরতে থাকুক, তোমাদের পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হোক।… গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রেখো না। তাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নেই- তারা একরকম মৃতকল্প বললেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর- যারা পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র কিন্তু বিশ্বাসী।…. কোন চালাকির প্রয়োজন নেই, চালাকির দ্বারা কিছুই হয় না।’
‘টাকা ছাড়া কিছুই নাই’ এই জাতীয় গরীবদের সংখ্যা দেশে হু হু করে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট থেকে জানা যায় দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা এরই মধ্যে লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এক সময় ‘লাখপতি’ শব্দটির উচ্চারণের সাথে সাথে দেহে এক রকমের শিহরণ জাগতো। আজকাল ‘কোটিপতি’ কোন শিহরণ জাগায় না। ‘শত কোটি’, ‘হাজার কোটি’র মালিকরা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
’৬৯, ’৭০, ’৭১-এ আমরা অখ- পাকিস্তানে ২৪ পরিবারের বিরুদ্ধে কতো আন্দোলন, সংগ্রাম মিটিং মিছিল করেছি; গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছি, সেগুলো আজ অতীত স্মৃতির মতোই লাগে। পাকিস্তান দু’টুকরো হলো। হলো বাংলাদেশ। এখানে তো ১২ পরিবার থাকার কথা। পঞ্চাশ বছরে হয়ে গেলো লাখ লাখ পরিবার। কেন এমন হলো? এটা খুঁজে বের করতে তো হাজারো বছরের গবেষণার প্রয়োজন নেই। দেশের সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ, নানা তত্ত্ব তথ্যের প-িত তাত্ত্বিক মহোদয়গণ, রাজনীতিবিদগণ একত্রে বসে ‘টাকা ছাড়া কিছুই নেই, ঐসব গরীবদের জন্ম ইতিহাস খুঁজলেই তো বের হয়ে আসবে। কিন্তু ৫০ বছর ধরে এ কাজটা আমরা করছি না। ফলে যা হবার তাই ঘটে যাচ্ছে। সত্যিকার গরীব আরো গরীবই হচ্ছে। একবার সিএনজি করে ঢাকার রাস্তায় যাচ্ছি। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। সামনে দুটো ‘সিএনজি’ এর পেছনের দু’টি বাক্সের দিকে চোখ পড়লো। একটি লিখা রয়েছে- ‘আমি ছোট আমাকে মেরো না’, অন্যটিতে লিখা- ‘মানুষের বিবেক সর্বোচ্চ আদালত।’
পেছনে বিরাটকায় ট্রাক গর্জন করছে। ছোট সিএনজিকে যেন পিষে মারতে উদ্যত। সমাজে আর্থিকভাবে ছোট, মানুষগুলোর অবস্থাও যেন তাই। আর জজ ব্যারিস্টার উকিল নিয়ে আদালত রাত পোহালেই ভীষণ সরব। কিন্তু জ্ঞাত-অজ্ঞাত কারণে ‘বিবেকের আদালত’ একেবারেই নীরব। এই নীরবতা সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে নিজের বিবেক খাটিয়ে কেউ তা দেখছেন বলে মনে হয় না। এদেশে ‘হারাম’ হালাল নিয়ে আলোচনার অন্ত নাই। কিন্তু এই শব্দ দু’টি সংজ্ঞা কেউ শিখছেন না। কে ‘হারাম’ ভক্ষণ করলো, কে ‘হালাল’ ভক্ষণ করলো এর খোঁজও কেউ করেন না। চারদিকে শুধুই ‘খাই খাই’ অবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘বেগমপাড়া’, ‘সাহেবপাড়া’, এর খবর গ্রামগঞ্জ-শহরে সবার মুখে আলোচ্য বিষয়। ধরে নিলাম ঐসব নাদুস নুদুস বেগমরা পরগাছা কিন্তু ঐ সাহেবরা তো পরগাছা নয়। ওরা তো গাছ। তারা তো জানেন গাছে ঝাড়া দিলেই নীচে কাড়ি কাড়ি টাকা পড়ে রঙ্গিন হয়ে যায়! ওদের বেতন তো বেগমরা জানেন। ওদের পুত্র কন্যা বা বাবা মা’দেরওতো অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে ঐ পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা যখন বেগমদের হাতে তুলে দেন তখন কি একবারও সাহেবকে ঐ টাকার উৎস জানার জন্য প্রশ্ন করেন? বাবা মা ছেলে মেয়েরা? কেউ করে না। হাসি হাসি মুখে সবাই- ‘হারাম’, ‘হালাল’ শব্দ দুটি বেমালুম ভুলে যান। এদিকে স্ত্রী পুত্র কন্যা যাদের নেই অর্থাৎ যে জীবনে বিয়েই করেনি তেমন অনেক ‘বিচ্ছিরি রকমের’ গরীবের দেখা আমরা আজকাল পাচ্ছি। যেমন ঐ বহুল আলোচিত পি.কে. হালদার। আসলেই এক গরীব দর্জির ছেলে সে। কি করলো? ও নাকি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলো। কার জন্য করলো সে নিজেও জানে না। কেন করছে এরকম? কারণ ওদের বিবেকের আদালতের বিচারক আজ মৃতপ্রায়। একই অবস্থা পি.কে. গোষ্ঠীর সহযোগীদেরও। বড়ো হাসি পায়, ঐ বিবেক বর্জিতদের মুখে যখন মানুষ শুনে ‘হারাম-হালাল’ এর কল্প কাহিনী।
ঐসব বিচ্ছিরি রকমের গরীবদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক রকমের আঘাত লাগছে। এর চেয়েও সাংঘাতিক ক্ষতি করছে দেশের যুব সমাজের। তাদের চরিত্রের। আগামী প্রজন্মের। মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ছে তা যুব সমাজে। দেশপ্রেম বলি, সাহিত্য সংস্কৃতি বলি সবকিছুই আজ চরম হুমকির মুখে। হুমকির মুখে শিক্ষা। শিক্ষক। মোট কথা মানবিকতা, মানবাধিকার আজ নির্বাসনে। এই নির্বাসন ঠেকাতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। এককালের গরীবের সন্তানেরা আজ বুর্জোয়ার কাতারে নাম লিখাচ্ছে। ক্ষতি নাই যদি তারা অন্তত দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া হতো। দেশ সমাজ-জাতি, রাষ্ট্র তথা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐ ‘বিচ্ছিরি রকমের গরীবদের বংশ বিস্তার রোধকল্পে এখনই জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ছে। এ জন্যে দেশের সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যই পারে সে কাজটি করতে। আর এক্ষেত্রে রাজনীতিতে আর্থিক স্বচ্ছতা, সততা তো থাকতেই হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।