মানসিক মুক্তির বিকাশই শিক্ষা
আফতাব চৌধুরী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৪:০৫:৪৭ অপরাহ্ন
ইভ-টিজিংকে বলা হয় সামাজিক অপরাধ। আজকাল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আধুনিক মার্কেট ও বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ইভটিজিং এর মত অপরাধ বেশিরভাগ সংগঠিত হতে দেখা যায়। ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার অভাবেই এ জাতীয় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সুধীমহলের ধারণা। শধু আইন প্রনয়ন আর তার প্রয়োগেই এ জাতীয় অপরাধ থেকে নি®কৃতি পাওয়া যাবে না। এজন্যে প্রয়োজন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সমাজজীবনে নৈতিক শিক্ষা এখন নিম্ন-পর্যায়ে। বিশ্বায়নের যুগে ভোগবাদী জীবনস্রোতে গা ভাসিয়ে এবং সনাতন ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে নির্বাসিত করে যে জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সেখানে নৈতিক বা ধর্মীয় শিক্ষার স্থান কোথায়? সেকেলে জীবনে প্রচলিত রীতিনীতি হালে অপাংক্তেয়। অস্থির ও চঞ্চল আধুনিক যুগে এ নীতিবোধ আঁকড়ে থাকলেও সম্ভাবনাময় জীবনকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। এ ধারণা শুধু ব্যষ্টিতে সীমাবদ্ধ নয়, সমষ্টিতে প্রসারিত। সৎভাবে সরল জীবনযাপন করার মধ্যে যে একটা আলাদা আনন্দ আছে আধুনিক এ ভোগবিলাসের সমাজ জীবনে তা সম্পূর্ণ অজানা। আমি যা আছি, বেশ আছি। এ জাতীয় ভাবনা যে ভোগমুখী মনে বিশ্রাম ও তৃপ্তি দিয়ে থাকে তা তাদের উপলব্ধিতে নেই।
সুস্থ জীবন যাপনের জন্য আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যেভাবে অপরিহার্য, নৈতিক স্বাস্থ্য সজীব এবং প্রাণবন্ত রাখা তদ্রুপ অভিপ্রেত। জীবনে উশৃঙ্খলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে আমরা নিজেরাই। পারিবারিক ও সমাজ জীবনের পরিম-ল এবং মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। সেটি তখন সম্ভব হবে যখন আমরা প্রাচীন প্রচলিত রীতিনীতিগুলো সেকেলে বলে জীবন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে না দেই। বতর্মানে এ নীতিবোধ ও নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত বলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে চলছে মৎস্যন্যায়। অটুট পারিবারিক বন্ধন, আল্লাহ ভয়, মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল, নিষ্ঠা ও আসক্তি, সংযত ও রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ, সমাজ চেতনা, সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে পারস্পরিক ব্যবহার, সহনশীলতা প্রভৃতি রীতিনীতিগুলো এককালে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সামগ্রিকভাবে আদৃত হত অলিখিত আইনরূপে প্রতিপালিতও হত। পারিবারিক জীবন ছিল তখন নিস্তরঙ্গ। আজকালকার অভিভাবকদের প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুদের নৈতিক শিক্ষা কী দেবেন, নিজেরাই এতে বিশ্বাসী নন। ব্যক্তিগত জীবনে তা পালনের প্রয়োজনীয়তা বোধ তো দূরঅস্ত। কিছু কিছু আটপৌঢ়ে দৃষ্টান্ত বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সদা সত্যাচারণ করার নীতি-সূত্রটি কিভাবে বিকৃত হচ্ছে তা দেখা যাক। বাড়িতে আসা কোন অবাঞ্ছিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে অনাগ্রহী পিতা তার সন্তানটিকে ডেকে বলছেনÑযা গিয়ে বল,বাবা বাড়িতে নেই। পারিবারিক রেশনকার্ডে চার জনের পরিবর্তে ছয়জন দেখানো হচ্ছেÑশিশুটি তখন হয়তো জিজ্ঞেস করল Ñআমাদের পরিবারে চার জন লোক আছে, ছয় জন কিভাবে হল! পিতা বলছেনÑতা তুমি বুঝবে না। বেশি রেশন পেতে হলে এরূপ লেখাতে হয়। শিশুটিকে ওই নীতিবাক্যটি শেখালেই যে সে মিথ্যাচারণে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে এর কোন গ্যারান্টি না থাকলেওÑএ আদর্শটি সামনে থাকলে সে শতবারের পরিবর্তে হয়তো দশ বার মিথ্যাচারণ করবে এবং যখনই করবে তখনই তার মন শঙ্কিত হবে অপরাধবোধ অনুভব করবে। নীতিবোধের প্রভাব তার উপর থাকবে। এ মনন আমাদের সমাজের মৃত্তিকাকে চিরকাল সিক্ত ও সজীব রেখেছে। আজকাল তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষক ও গুরুজনে শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের সমাজে এক সর্বজন গ্রাহ্য ও চিরাচরিত আদর্শ। কিন্তু হালে এই আদর্শটি কিভাবে অবহেলিত হচ্ছে Ñএর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। শিশুটি হয়তো পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। অভিভাবক শিশুটির যোগ্যতা বা পড়াশোনায় অমনোযোগিতার বিচার না করেই তারই সামনে তার প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে অকাতরে বিরূপ মন্তব্য ও অসম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। এমনও অভিভাবক আছেন যারা স্থান,কাল, পাত্র ভুলে শিশুদের সামনে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের পিতা-মাতার প্রতি অশোভন মন্তব্য করতে পিছপা হন না। শিশুরা তাদের পিতা-মাতার থেকে যে শিক্ষা পেল, তাতে তারা কি কখনও গুরুজনে শ্রদ্ধাশীল হবে? এ ভাবেই নৈতিক শিক্ষা সমাজ থেকে তাড়িত হচ্ছে।
চুরি করা মহাপাপ, এ তৃতীয় দৃষ্টান্তটি বিশেষ তাৎপর্যময়। এ নৈতিক উপদেশটি কি আজকাল পালিত হচ্ছে? দৈনিক পত্রিকা খুললে দেখা যাবে সরকারি-বেসরকারি অর্থের হেরফের সাতকাহন, পুকুরচুরির বিস্তারিত বিবরণ। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক কখনও বা শিশুদের বঞ্চিত করে শিশুদের ভোজ্য সামগ্রী আত্বসাতের খবরও আজকাল কাগজে বেরোচ্ছে। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষনের খবরও পত্রপত্রিকায় হর হামেশাই প্রকাশিত হচ্ছে। আগেকার দিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা থাকত, যা ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই লেখানো হত সদা সত্য কথা বলবে, কখনও মিথ্যা বলবেনা, চুরি করা মহাপাপ, গুরুদের সম্মান করবে, ছোটদের আদর করবে ইত্যাদি। একটা সময় ছিল ,যখন শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় আরও অনেক নৈতিক শিক্ষা শিশুদের প্রতিটি পরিবারে দেওয়া হত, যাতে শিশুগুলোর শিশুবেলা থেকে সুন্দর নৈতিক জীবন গড়ে ওঠে। কিন্তু হালে অর্থসন্ধানে ধাবমান জীবনে ও আতকেন্দ্রিক মানসিকতা নৈতিকতা বা নীতি শিক্ষার স্থান নেই বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজেদেরে যত অত্যাধুনিক বলে বড়াই করে না কেন, সে কখনও অতীতের বাধঁন ছিন্ন করতে পারে না। যখন সে অতীতের দিকে তাকাতে অনীহা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে, তখন সে নিজেকে অন্ধ গলির মধ্যে আবদ্ধ দেখেছে। ভোগবাদী ও আত্মহিতায় নিবেদিত প্রাণ জীবন পদ্ধতিতে মুল্যবোধ সামঞ্জস্যহীন ও বিপথগামী হয়ে পড়েছে। আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছিনা যে যাকে আমরা অগ্রগতি বলে ধরে নিয়েছি, আসলে তা মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। যে নীতি শিক্ষা প্রত্যেকটি পারিবারিক জীবনে সুস্থ পরিবেশ ও সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে সেটা আমরা মানতে রাজি নই। নৈতিক জীবন গঠনের চাইতে আর্থিক সমৃদ্ধি আমাদের কাম্য। ভাবিÑমর্যালিটি বা নৈতিক শিক্ষা আমাদের অগ্রগতির পথে বাধাস্বরূপ। চারিদিকে যে অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজ জীবনকে আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত করে চলেছেÑতা আমাদের শঙ্কিত করলেও আমরা অসহায়। শিক্ষিত, অতি শিক্ষিত ব্যক্তিও সময় সময় নৈতিকতা দূরে ঠেলে দিয়ে যে দুর্নীতি ও অপরাধ করে যাচ্ছেন তা নিশ্চয় বেদনাদায়ক। তাহলে কি বলব জীবনে পাপ-পূণ্য ধারণা বলে কিছু নেই।
রক্ষণশীল ও প্রগতি বিরোধী ভর্ৎসনা মেনে নিয়ে বলছিÑনীতি শিক্ষা বা মর্যাল এডুকেশন আমাদের বিপথগামী সমাজকে পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আর এটা সম্ভব একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমেই। সমাজে সমৃদ্ধি হয়তো এসেছে,কিন্তু সুখ ও স্বস্তির মুখ দর্শন হচ্ছে না। সচেতন থাকা ভালÑঅর্থভা-ার সব সময় মূল ভা-ার না-ও হতে পারে। তাই আমাদের পরিবারের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে তাদের বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এক সুহৃদয় সাহিত্যিকের ভাষায় Ñ মানুষ মাতৃস্তনে যা শিক্ষা লাভ করে জীবনে তা কখনও বিস্মৃত হয় না। একটি শিশুর চরিত্র গঠন হয় তার জীবনের প্রথম পনেরো বছরে। নৈতিকতা হচ্ছে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ যা মানুষের আচরণকে সুষ্ঠু পরিচালিত করে। এ বিচার বুদ্ধি আল্লাহর এক অমূল্য দানÑযার সঠিক প্রয়োগ মানুষের বন্য প্রকৃতিকে সংযত করে শোধিত করে, উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাস প্রতিষ্ঠিত করে তাকে স্বভূমিকায়। ক্রোধ, লোভ,সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি, নিষ্ঠুরতা, দ্বেষ, হিংসা কাম, ধূর্ততাÑএ সবগুলিকে নীতিজ্ঞান বিকাশ করতে সমর্থ। এগুলো যে আমরা জানি না তা নয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে এগুলোর প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। নীতি শিক্ষা মানুষের বিবেককে জাগ্রত রাখে, সে বিবেক যদি জাগ্রত না থাকে, তা হলে সে যে কোন গর্হিত কাজ করতে দ্বিধাবোধ করবে না। হালে তাই হচ্ছে। সভ্যতার মূল ঊদ্দেশ্য যদি মানবকল্যাণ সাধন হয়ে থাকে, তা হলে কিছু সংখ্যক নীতিগত আদর্শবোধ ছাড়া তা হবে না। এ অবস্থায় অস্ট্রিচ পাখির মতো ধুলোতে মুখ থুবড়ে থাকলে চলবে না। গৃহ এ শিক্ষার প্রকৃত স্থান এবং পিতা-মাতা এ শিক্ষার আদর্শ শিক্ষক। শুধু বিদ্যালয়ে মর্যাল সায়েন্স বা নীতিশিক্ষা পাঠ্যবিষয়ে সংযোজন করে এ শিক্ষা দেওয়া যাবে না। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, এভাবে পাঠ্য হিসেবে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কেননা সে ক্ষেত্রে বিদ্যার্থীরা নিজেদের জীবনে এগুলোর আচরণের চিন্তা না করে মুখস্থ করে মার্কস পাবার জন্য বেশি তৎপর হয়ে থাকে। ফলে যে উদ্দেশে নীতি শিক্ষার প্রচলন করা তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কাজেই ঘরে মূলত এ শিক্ষা দিতে গেলে পিতা-মাতাকে Ñআপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাওÑএ আদর্শ অবলম্বন করতে হবে। শুধু শিক্ষিত হলে চলবে না। নৈতিকতার ওপর জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হতে হবে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে-তা না হলে শিক্ষিত ব্যক্তির অনৈতিক আচরণে শিক্ষার মর্যাদা রক্ষিত হবে না। অধুনা সরকার মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার পরিবর্তে গ্রেড প্রথার চালু করেছেন। শিক্ষাবোর্ডে তা কার্যকরও করা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে জোর দেওয়া হত ছাত্রছাত্রীর পারফরম্যান্সের ওপর, গ্রেড সিস্টেমে এসে যাবে শিক্ষকদের নীতিবোধের প্রশ্ন। তাদের সবার মানসিকতা কি সব ক্ষেত্রে নীতিজ্ঞান সমৃদ্ধ? গ্রেড নিরূপণ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে জাত হারাবে না তো? মর্যাল উপেক্ষিত আধুনিক জীবনে এ জাতীয় প্রশ্ন স্বভাবতই উঠে আসে।
নতুন যুগে নতুন কুশীলবদের নতুন চাহিদা থাকবে এটা স্বাভাবিক। বিশ্বায়নের যুগে সঙ্গতি রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবেÑসেটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশীয় পরিবার ও সমাজ থেকে সংস্কার এবং নীতি শিক্ষার অপমৃত্যু ঘটাতে হবে সেটা ভ্রান্ত ধারণা। আমরা কি একবারও ভাবি অগ্রগতি ও আধুনিকতার আবর্তে আমরা ক্রমে ক্রমে আমাদের জাতীয় সত্ত্বা হারাতে বসেছি। মনে রাখতে হবে, আমাদের ঐতিহ্য ও জীবন ভাবনা অন্য যে কোন দেশের থেকে একেবারে পৃথক। এ স্বাতন্ত্র্য আমাদের হারানো উচিত হবে না। সত্যি কথা বলতে কী প্রগতি ও নৈতিকতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। প্রয়োজন শুধু দু’য়ের মধ্যে যথাযথ সমতা রক্ষার মানসিকতা সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাসমৃদ্ধ প্রগতি ও নৈতিক দৃঢ়তা এবং নীতি শিক্ষার মর্যাদা-দুই-ই আমাদের সংস্কৃতির পরমায়ুর জন্য প্রয়োজন। এ দু’য়ের মিলনেই হতে পারে আমাদের জীবন উদ্ভাসিত। এ সদিচ্ছা কি পুনরায় ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনে জেগে উঠবে, প্রবন্ধকারের এ আবেদন কি অন্ধের সামনে আরশি ধরার মতো নিরর্থক বিবেচিত হবে?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।