কারো পাপের ভাগী যেন না হই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১:৩৮:০৪ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
ছোটবেলা বড়দের কাছ থেকে প্রায়শই একটি গল্প শুনতাম এবং গুরুজন ঐ গল্পের মাধ্যমে নৈতিকতা-সততা, ইত্যাদি মানবিকতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এমন গল্প শুনানো হতো। আর সেকালে শ্রোতার সংখ্যা খুব একটা কম ছিলো না। অনেকে অনেক আগ্রহ নিয়েই গল্পের কাহিনীটি শুনে শুনে নিজেদের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে খানিকটা হলেও চেষ্টা করতো। জীবনের সত্তরটিরও বেশি শীত-বসন্ত-হেমন্ত পেরিয়ে আজো মাঝে মাঝে গল্পটি শ্রুত হতে দেখি। কিন্তু এর প্রাসঙ্গিকতা একেবারে উল্টো বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
গল্পটি এ রকম- এক দুর্ধর্ষ ডাকাত প্রতিদিন ডাকাতি করে বেড়াত। পথে পথে পথিকদের সর্বস্ব লুট করে প্রচুর টাকা পয়সা ধন সম্পদ আহরণ করে তার পরিবারের সকল সদস্যের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতো। পরিবারের কর্তা হিসেবে পরিবারের সদস্য অর্থাৎ বাবা-মা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলকে রাজকীয় কায়দায় জীবন যাপন করার ব্যবস্থা করতে পেরে সে নিজেকে খুবই সফল মানুষ ভাবতে থাকে এবং এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নাই। বৈধ অবৈধ পথ বা হারাম-হালাল-পাপ-পুণ্য-নীতি-নৈতিকতা তার ভাবনার বিষয় ছিল না; পরিবারের সবাইকে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রাচুর্য্যরে মধ্যে বিলাসী জীবন যাপন করাতে পারছে এটাই তো তার সত্যিকার সংসার ধর্ম। এমনি করতে করতে একদিন তার ডাকাতির শিকার হলেন এক বয়স্ক দম্পতি। তারা তাদের সব কিছু সহায় সম্বল রতœাকর দস্যু নামক ডাকাতের হাতে তুলে দিয়ে বললেন- বাবা ডাকাতির এই মালামাল দিয়ে তুমি কি করো? রতœাকর দস্যু গর্বিত কন্ঠে বলে- কেন, এ দিয়ে আমি আমার বাবা মা স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাইকে তাদের ইচ্ছে মতো খাওয়াই। দম্পতি বললেন- তোমার এ পাপের উপার্জনের ভাগ কি তারা নেবেন? তোমার পাপের অংশীদার তারা হবেন?
রতœাকর দস্যু বলেন, কেন নেবে না। অবশ্যই নিতে হবে।
দম্পতি বলেন, বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখো তো তোমার পাপের ভাগি তারা হয় কিনা।
রতœাকর দস্যু বাড়িতে গিয়ে সবাইকে ডেকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে সবারই এক উত্তর- তোমার কোন পাপের ভাগি আমরা হবো না। সততার সঙ্গে উপার্জন করে খাওয়ানো-পড়ানো তোমার কর্তব্য। তোমার পাপের ভাগীদার আমরা কেউ নই। এ কথা শুনার পর এই রতœাকর দস্যুর চিন্তা জগতে, ভাবনার জগতে বিরাট পরিবর্তন দেখা দিলো। সারাজীবনের পাপ থেকে মুক্তির জন্য সাধনা শুরু করে দিলেন। তারপর তিনি এমন এক সাধক হয়ে উঠলেন যে, একদিন ঐ কথিত ডাকাত, কথিত দস্যু কথিত বাল্মীকি মুনি হয়ে উঠলেন।
এই অতি প্রাচীন, অতি সাধারণ গল্পটির সাথে আমাদের আজকের সমাজ-দেশ-রাষ্ট্রের কিছু কিছু মানুষের নতুন ধরনের ডাকাতির তুলনা করলে অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে। তবে যাই বের হয়ে আসুক না কেন, আজকালকার কোন ডাকাতের মধ্যেই মুনি হবার কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আজকের ডাকাত গোষ্ঠী গল্পের উল্লেখিত ডাকাতের মতো পথিকের সামান্য ধন সম্পদ চুরি/ডাকাতি করে না। ওদের চাহিদা সীমাহীন। হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি ছাড়া ওরা ডাকাতি করে না। ওরা আবার টাকা পয়সা ধন সম্পদ বিদেশে পাচারকারীও বটে। আর দুঃখজনক হলেও ঐসব ডাকাতদের আমরা সমাজে স্যার স্যার বলি। তেমনি অনেক (স্যার!) নাকি কানাডায় বেগম পাড়া তৈরি করেছেন। সাম্প্রতিককালে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমসের সুরক্ষিত গুদাম থেকে নাকি ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব হয়েছে। এ নিয়ে ৭.৯.২০২৩ তারিখের আমাদের সময় শিরোনাম লিখে ‘গা বাঁচাতে স্বর্ণ কিনে ফের ভল্টে রাখে লুটেরা চক্র, ফাঁসছেন দুই ডজন কাস্টমস কর্মকর্তা।’ একই বিষয়ে ১০.৯.২০২৩ তারিখের একই পত্রিকা লিখে- ‘সাবেক কমিশনারসহ জড়িত ৭ কর্মকর্তা, এনবিআরের মুখে কুলুপ, ২০ দিনেও করেনি তদন্ত কমিটি।’ আর একদল আছে ব্যাংকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। ঐ ডাকাত দল নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে সিঁদকেটে ব্যাংকে ঢুকে তথাকথিত ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। আর লুটেরা বলবো কেন, ওরা ডাকাতি করেই কুকর্মটি করে। বলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক কর্মকর্তারা অনেকটাই অসহায় কিছু কিছু অতিলোভী চোর ছাড়া অনেকেই চাকরী হারানোর ভয়েই সততার মহাশক্তিকে অসতের রক্তচক্ষুর কাছে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। আর এছাড়াও কত কিসিমের ডাক্কুর দল যে সমাজে বিচরণ করছে তার কোন হিসেব নেই। ওদের টিকিটিই কেউ ধরতে পারেন না। মাঝে মাঝে দুদকের জালে হঠাৎ হঠাৎ কিছু রাঘব বোয়াল ধরা পড়ে। তাতে কী? অদৃশ্য শক্তি বলে ওরা জাল ছিন্ন ভিন্ন করে ওরা বের হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো সরিষায়ও যে ভূতের দেখা মেলে না তাও কিন্তু নয়।
এতোক্ষণ এই যে ডাকাতদলের কথা বলা হলো তারা কিন্তু আসলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো তাদের লুন্ঠিত ধন দিয়ে যে জায়গা জমি-প্লট-ফ্ল্যাট যাই ক্রয় করুক তা কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর নামে। স্ত্রীর মায়ের নামেই ক্রয় করা হয়। কখনো বা শালা শালীর নাম। বাবা-মা-ভাইবোন এখানে কখনো মূখ্য বিষয় হয় না। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রী-শ্বাশুরীর নামই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তবে মাঝে মাঝে বাদ সাধে দুদকের কিছু কিছু বেরসিক কর্মকর্তা। তাদের স্ত্রী ধনদের নামে প্লট-ফ্ল্যাট জায়গা-জমি ব্যাংক হিসাবের টাকার উৎস জানতে চায়। ফেঁসে যায় দুদকের জালে। অনেকেই জাল ছিঁড়ে ফেলে। বোকারা পারে না, জায়গা হয় লাল ঘরে।
এই যে অহরহ চুরি/ডাকাতির ঘটনা ঘটে চলছে সেখানে ঐ ডাকাত দলকে কেউ জিজ্ঞেস করছে না তাদের এই ডাকাতির পাপের ভাগী কী তাদের স্ত্রী পুত্র কন্যা বা বাবা মা হবেন। এই জিজ্ঞেস না করার হয়তো কারণও রয়েছে। আর সেটি হতে পারে- তারা তো কোন পথিকের সম্বল ডাকাতি করছে না। লুট করছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সরকারি মাল। অনেকটা এরকম যে সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল। আর জিজ্ঞেস করার দরকারটাই বা কি। এটা তো সেই রতœাকর দস্যুর যুগ নয়? ঐসব লুটেরা ডাকাতদলের স্ত্রী পুত্র কন্যা বাবা মা সবাই তো জানতে পারছে, দেখতে পারছে তাদের পুত্র ধন, স্বামী ধনের চাকরী বাকরির বেতন কত। অবশ্যই শত শত লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা নয়। যদি তাই হয় তাহলে কেউ তো প্রশ্ন করছেন না- ওগো প্রিয়তম স্বামীধন, ওরে সাধের পুত্রধনেরা টাকার এতো রঙ্গিন পাখা কোথায় পেলে? এমন প্রশ্নতো করছেনই না বরং বিশেষ চতুষ্পদ প্রাণীর মতো খেয়ে খেয়ে মোটা তাজা হতে মোটেই লজ্জা পাচ্ছেন না। যদিও তারা বিশেষ উৎসবে-আসরে-আলাপনে হারাম-হালাল-বৈধ-অবৈধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে বিজয়ী হবার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। তাইতো দেখি ঋণখেলাপী রূপী ডাকাতদের নিয়ে এক মামলায় আপিল বিভাগ এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গরিব কৃষকের নেওয়া ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণের অর্থ উদ্ধারে কোমরে দড়ি বেঁধে আনা হয়, অন্যদিকে শত শত কোটি টাকার ঋণ যাতে পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। অর্থাৎ নব্য রতœাকরেরা নানা ফন্দিফিকির আর কূটকৌশলে সরকারি টাকা তথা দেশের জনগণের অর্থ সম্পদ টাকা কড়ি লুট করেই চলছে। অথচ এদের সহযোগীরা, ওদের রক্ষাকারীরা তাদেরকে ডাকাত বলতে রাজি নয়। এজন্যেই তাদেরকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ঐ যে একটা গানের কলি আছেনা-লুট, লুটরে ভাই হরিবল বইলে’ অনেকটা সেরকমই। তবে এ ‘লুট’ সে লুট নয়। এই দুই লুটের পার্থক্য চোর/ডাকাতরা ঠিকই বুঝে। ডাকাতের লুট মানুষ মেরে আর ঐ গানের ‘লুট’ এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা।
ঐসব রতœাকররূপী আজকের ডাকাতদের লোভ-লালসা আর টাকার প্রতি যে আসক্তি তা থামানো যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু চেষ্টা করলে দেখতে তো মানা নেই। সে চেষ্টাটি করতে পারেন তাদের মা বাবা স্ত্রী পুত্র কন্যা তথা পরিবারের সদস্যগণ। বিজ্ঞজন বলেন, পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়। ঐ পাপীরা তো আমাদেরই একেকজন। পরিবারের একেকজন। রতœাকর দস্যুর পরিবারের সদস্যরা যেভাবে যেভাবে রতœাকরকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তার পাপের ভাগী তারা হবেন না সেই ভাবে তারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আর পাপ পুণ্যের কথা না-ই বা বললাম, স্বামী জেলের ভাত খেলে স্ত্রী পুত্র কন্যার মুখে পোলাও কোর্মার কি তেমন স্বাদ মিলতে পারে? আর এটাওতো ঠিক যে, স্ত্রীর নামে বাড়ি গাড়ি লিখে দিয়ে ডাকাতদের কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শেষ রক্ষা হয় না। ধরা পড়লে দু’জনকেই লালঘরকে নিজেদের ঠিকানা হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এতে পুত্র কন্যাদের সামাজিক/মানসিক অবস্থা কেমন হবে তা কি ভাবা যায়? কি অপরাধ নিষ্পাপ শিশুদের। তাই নব্য রতœাকর দস্যুদের পরিবারের সকল সদস্যদের এ নিয়ে ভাবনার বোধ হয় সময় এসেছে। এতে করে ঐ দস্যুরা মুনি-ঋষি-পীর না হোক, সমাজের একেকজন ভালো মানুষ হিসেবে তো বাঁচতে পারবেন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।