কুশীলবদের পরিণতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৬:৩১ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
বাংলা ও বাঙালির জাতীয় বীর বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডির মহানায়ক। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা-বাঙালির ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দুঃখের দিন, কলঙ্কময় দিন। ঐদিন যুদ্ধের নামে বিনা যুদ্ধে বেঈমান মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ১৯০ বছর অস্তমিত ছিল।
সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার হাজার মাইল দূর থেকে ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আসা বৃটিশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইস্ট ই-িয়া কোম্পানীর কর্মকর্তা রবার্ট ক্লাইভ মাত্র ১২০০শত ব্রিটিশ এবং ২০০০ হাজার দেশীয় ভাড়াটে সিপাহী মিলে মাত্র ৩২০০ সৈন্যবাহিনী নিয়ে ৫০,০০০ হাজার নবাব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত মুর্শিদাবাদ অবিমুখে রওয়ানা দেন। রবার্ট ক্লাইভ এত স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণে বাংলার নবাবের প্রধান সিপাহশালার বেঈমান মীর জাফর আলী খাঁন-এর রাজধানী আক্রমণের আমন্ত্রণ ছিল। মীরজাফরের মধ্যে ইংরেজদের ইতোপূর্বে এই মর্মে গোপন চুক্তি হয়েছিল।
পলাশী যুদ্ধের কুশীলবদের সবাই আজ মৃত না ফেরার দেশে। কেবলমাত্র মীরজাফর নামটি বেঁচে আছে বিশ্বাসঘাতক এর রূপক হিসাবে। কিন্তু কাকতালীয় (কো-ইনসিডেন্স) হলো পলাশীর যুদ্ধে নবাব তথা জাতির সঙ্গে যারা বেঈমানী করেছিল তাদের কারও ভাগ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি। আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো পলাশীর যুদ্ধের কুশীলবদের পরিণতি।
পলাশীর যুদ্ধের ১০ বছর পর ১৭৬৭ সালে লর্ড ক্লাইভ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন কিন্তু তিনি ভারতবর্ষে রেখে যান প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দুর্বৃত্তায়ন আর অপরাজনীতির এক কুপ্রথা। লর্ড ক্লাইভের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ১৭৭২ সালে তৎকালীন বৃটিশ পার্লামেন্ট বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। এতে একে একে বের হতে থাকে তার চরিত্রের কুৎসিত রূপ।
সমস্ত ধনসম্পদের বিনিময়ে তদন্ত বন্ধ করার সব চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন এবং অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে ২২ নভেম্বর ১৭৭৪ সালে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উমি চাঁদ। কথা ছিল পলাশীর যুদ্ধ শেষে প্রাপ্ত সব সম্পদের এক পঞ্চমাংশ পাবেন উমি চাঁদ। কিন্তু সুচতুর লর্ড ক্লাইভ কথা রাখেননি। অর্থ শোকে উমি চাঁদ পাগল হয়ে মারা যান।
মীরজাফরের জামাতা মীর কাশেম পলাশী যুদ্ধের পর নবাবের বন্দী স্ত্রী লুৎফুন্নেসার উপর অকথ্য অত্যাচার চালান গুপ্তধনের আশায়। ইংরেজদের হাত ধরে মীরকাশেম কিছুদিনের জন্য নবাবও হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ২৩ অক্টোবর ১৭৬৪ সালে ‘বকসারের’ যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে তিনি পরাজিত হন এবং দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ভারতের বিভিন্নস্থানে পালিয়ে বেড়ান এবং বিনা চিকিৎসায় ৮ মে ১৭৭৭ইং তারিখে মৃত্যু ঘটে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো মৃত্যুর পর তার কাছে পাওয়া যায় একমাত্র সম্বল দুটি চাদর। একটি চাদর বিক্রি করে তাকে দাফন করা হয় চরম অবহেলায়। পলাশীর যুদ্ধের আগে ইংরেজদের সামনে মীরজাফর যখন পবিত্র ‘কুরআন’ মাথায় নিয়ে নবাবের বিরুদ্ধে যাওয়ার শপথ নেন, তখন মীরজাফরের আরেক হাত ছিল নিজপুত্র মীর মিরনের মাথায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ৩ জুলাই ১৭৬০ সালে বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটে মীর মিরনের। পলাশী যুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল ধনী ব্যবসায়ী জগৎশেঠ। যুদ্ধ শেষে মীরজাফরের শাসনামলে জগৎশেঠ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন এতে ক্ষিপ্ত মীরজাফর তখন জগৎশেঠকে বিতাড়িত করলে তার নতুন আস্তানা হয় ‘মংঘর’ নামক স্থানে।
ইংরেজদের সঙ্গে প্রথমে সখ্য থাকলেও পরে সে সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ে এক যুদ্ধে মীরজাফর ইংরেজদের কাছে হেরে যান। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজদের সহায়তাকারী জগৎশেঠের শিরচ্ছেদ করেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বড়খালা ছিলেন ঘসেটি বেগম। পলাশী যুদ্ধের আগে তিনি গোপনে হাত মেলান ইংরেজদের সঙ্গে। যুদ্ধের পরে নানা কারণে এই সখ্যতা ভেঙ্গে গেলে বন্দী করা হয় ঘসেটি বেগমকে এবং তাকে বন্দী করে রাখা হয় ঢাকার জিঞ্জিরার একটি প্রাসাদে। তাকে মুর্শিদাবাদে নৌকাযোগে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর নৌকা ডুবিতে সলিল সমাধি হয়। তাইতো বলা হয়ে থাকে বাংলার মাটিও ঠাঁই দেয়নি কুচক্রী ঘসেটি বেগমকে।
পলাশী যুদ্ধের মূল বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর শেষ জীবনে ইংরেজদের অবজ্ঞা আর দেশীয়দের ঘৃণার পাত্র হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত থেকে ১৭ জানুয়ারি ১৭৬৫ সালে ইহধাম ত্যাগ করলেও ইতিহাসের পাতায় ‘মীরজাফর’ নামে বিশ্বাস ঘাতকদের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় হিসাবে বেঁচে থাকবেন একটি ঘৃণিত ও নিন্দিত নাম নিয়ে। কাজেই, পরিশেষে বলা যায়, বাংলা ও বাঙালি সমাজে বিশ্বাসঘাতকের আরেক নাম ‘মীরজাফর’।