রেটিং এজেন্সির বিশ্বাসযোগ্যতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৮:৪৮ অপরাহ্ন
অন্জন কুমার রায়
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুরস (এসএ্যান্ডপি) সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং স্কোর অবনমন করেছে। পাশাপাশি মুডিস ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিসও বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ডাউনগ্রেড করেছে। সাতটি বেসরকারী ব্যাংককে নেতিবাচক রেটিং দিয়েছে মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস। বাংলাদেশের ঋণমান একধাপ কমিয়ে বিএ-৩ থেকে বি১- এ অবনমন করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্য ঝুঁকি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও কয়েকটি ব্যাংকের ঋণমান অবনমন করেছে মুডিস রেটিং এজেন্সি। পাশাপাশি এসএ্যা-পি গ্লোবাল রেটিংসও তাদের ঋণমান ডাউনগ্রেড করেছে। অন্য বড় ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান ফিচ কিছুদিন আগে ক্রেডিট রেটিং এএএ থেকে এএ প্লাস স্তরে অবনমন করেছে। ফিচের মতে, আমেরিকার ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, ধারের ঊর্ধ্বসীমা এবং দেশে মন্দার ঝুঁকি থাকায় মূল্যায়ন কমেছে। পাশাপাশি ফিচ রেটিং এজেন্সি দাবি করে, আগামী তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব চলমান থাকবে। যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ অবনমনের প্রভাব সীমিত সময়ের জন্য থাকবে।
চলমান বৈশ্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক দেশের সার্বভৌম ঋণমান ডাউনগ্রেড করা হয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ জনিত প্রভাব এবং রাশিয়া- ইউক্রেনের যুদ্ধ এর অন্যতম কারণ। বৈশ্বিক অর্থনীতির স্কংটময় এমন মুহূর্তে কিছু কিছু দেশের রেটিং কমে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিচার্স (এনবিইআর)’র দুই অর্থনীতিবিদ গবেষণায় বলেছেন, উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোয় ডলারের মূল্যমান ১০ শতাংশ বেড়ে গেলে এক বছর পর তাদের উৎপাদন ১ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যাবে। তবে, উৎপাদন কমে যাওয়া অব্যাহত থাকবে আড়াই বছর পর্যন্ত। সে হিসেবে ২০২৪ সালের জুন মাসের শেষ নাগাদ রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারে। কোভিড পূর্ববর্তী পর্যায়ে যেতে দুই-তিন বছর লেগে যেতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী ডলারের মূল্যবৃদ্ধির দরুণ উঠতি দেশগুলোর বাণিজ্য ও আর্থিক খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যার ফলে ঋণমানও খারাপ হচ্ছে।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করতে হয়। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে কতটুকু নিরাপত্তার সাথে লেনদেন করা যায় তা ক্রেডিট রেটিং নিরুপন করে থাকে। সাধারণত যে সকল দেশ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ গ্রহণের সক্ষমতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় তাদের জন্য রেটিং এজেন্সিগুলো ক্রেডিট রেটিং সম্পন্ন করে থাকে। কাউকে ঋণ দিলে সেই অর্থ ফেরত পাওয়া কতটা ঝুঁকি তা মূল্যায়ন করে ক্রেডিট রেটিং। ঋণ ফেরত পাবার ঝুঁকি যত কম লগ্নি পাবার যোগ্যতা তত বেশি। ক্রেডিট রেটিং বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও বরাদ্ধ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সুদহার নির্ধারণকেও প্রভাবিত করে। রেটিং ভাল হলে সহজ এবং কম শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। অপরদিকে রেটিং মান খারাপ হলে ঋণ দাতারা তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে কড়া শর্তে বেশি সুদ আরোপ করে থাকে। ক্ষেত্রেবিশেষে এই রেটিং কখনো বাড়তে পারে আবার কখনো কমতে পারে। যদিও অনেক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ না করে নিজস্ব রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে।
আশি এবং নব্বই দশকে যুক্তরাষ্ট্রে মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাই রিয়েল এস্টেট সেক্টরে মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিজ প্রোডাক্টের প্রচলন করা হয়েছিল। বিনিয়োগকারীরাও অতি মুনাফা লাভের আশায় রিয়েল এস্টেট ব্যাকড সিকিউরিটি কিনতে থাকে। সেক্ষেত্রে মন্দ বা সাবপ্রাইম অ্যাসেটের (যেমন গৃহঋণ যা ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই) বিপরীতে ইস্যু করা সিকিউরিটিগুলোকে ভালো সিকিউরিটির সাথে বিক্রি করে সহজেই বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হতো। যা ঈড়ষষধঃবৎধষ উবনঃ ঙনষরমধঃরড়হ বা ঈউঙ নামে পরিচিত। অথচ, সিকিউরিটাইজেশনে ভাল-মন্দ সকল ধরণের অ্যাসেট একসাথে ইস্যু করা ছিল সিকিউরিটাইজেশনের অন্যতম দুর্বলতা। সে সময় ক্রেডিট রেটিং কোম্পানীগুলো মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিকে মোটামোটি ভাল বা বেশ ভাল রেটিং দিয়ে দিত। যেখানে রেটিং কোম্পানিগুলো অতি স্বচ্ছতার সাথে ক্রেডিট রেটিং বিশ্লেষণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। অপরদিকে মোটামোটি ভাল বা বেশ ভাল রেটিংয়ের জন্য বিনিয়োগকারীরা অতি সহজে মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট হয়েছিল। কারণ, বিনিয়োগকারীরা শুধু ক্রেডিট রেটিংকে আদর্শ মনে করে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়েছিল। ফলে, বিগ থ্রী (মুডি’স, এঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস ও ফিচ) রেটিং এজেন্সিগুলোকে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এনরন কেলেঙ্কারি চলাকালীন সময়ে রেটিং এজেন্সি সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো সামনে নিয়ে আসা হয়। কারণ, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এনরনকে পুরোপুরি যাচাই করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে সাবপ্রাইম মর্টগেজের সময় সিকিউরিটিজের দাম কমতে শুরু করলে বন্ডগুলোকে এএএ-রেটিং দিয়েছিল রেটিং এজেন্সিগুলো। যা অনেক বিনিয়োগকারীকে বিশ্বাস করতে পরিচালিত করেছিল যে বিনিয়োগগুলো অত্যন্ত নিরাপদ এবং কম ঝুঁকিসম্পন্ন। অনেকের মতে, সাবপ্রাইম মর্টগেজের সঙ্কটময় মুহূর্তে বন্ডগুলোকে এএএ-রেটিং দেওয়ার কারণে আমেরিকার সাবপ্রাইম মর্টগেজ সঙ্কট আরো ঘনিভূত হয়েছিল। যার ফলে ভাল রেটিং দেওয়া অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়েছিল। যার মধ্যে অন্যতম হলো লেম্যান ব্রাদার্স, বিয়ার স্টার্নস। পরবর্তীতে এ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। মূলত রেটিং এজেন্সিগুলি আবাসনের মূল্য হ্রাসের সম্ভাবনা এবং ঋণ খেলাপিতে নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ২০০৮ সালের মন্দার পর থেকে আমেরিকার বিগ থ্রী ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
এছাড়া ২০০৯ সালে ইউরোপে সার্বভৌম ঋণ সঙ্কটের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। ইউরোপে সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং নিয়ে বিগ থ্রি আরো বিতর্কের জন্ম দেয়। গ্রীস, পর্তুগাল এবং আয়াারল্যান্ডের মতো সংকট-বিধ্বস্ত দেশগুলির পাবলিক ঋণকে “জাঙ্ক” গ্রেডে অবনমন করে। এমনকি ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং অন্যান্য প্রধান ইউরোজোন অর্থনীতির ঋণযোগ্যতাও সাথে সাথে কমিয়ে দেয়। যার ফলে ঋণ সঙ্কট আরো ঘনিভূত হয়ে আসে। এই সার্বভৌম ঋণ সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলতে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিকে দায়ী করা হয়। ইইউ মতে, “এই পদক্ষেপগুলি ইউরোজোনের সার্বভৌম ঋণ সংকটকে ত্বরান্বিত করেছে , যার ফলে একটি স্বাধীন ইউরোপীয় রেটিং এজেন্সি তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে”।
আইএমএফ ব্যবস্থা সংস্কার সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের বিশেষ কমিশন (স্টিগলিজ কমিশন) মতে, ‘ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত এবং অকার্যকর’। অপরদিকে ইউএসএসইসি ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং রেটিং বিশ্লেষণে রেটিং এজেন্সির নি¤œমানের রেটিংয়ের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের বিদেশী ঋণ ও মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ ইউফেন লি একটি প্রতিবেদনে রেটিং সম্পর্কে বলেন, রেটিং এজেন্সি উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক বাজারের পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ স্কংটে থাকা দেশগুলোর সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া রেটিং ডাউনগ্রেড অনেক দেশের মহামারী পুনরুদ্ধারে সরকারগুলোকে আর্থিক ব্যয়ে অনুৎসাহিত করছে।
বস্তুত, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ভাল সময়ে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়াকে উৎসাহিত করতে পারে এবং খারাপ সময়ে ঋণের সঙ্কট আরো গভীর করে তুলতে পারে। আমেরিকার সাবপ্রাইম মর্টগেজ এবং ইউরোপের সার্বভৌম ঋণ সঙ্কট যার অন্যতম উদাহরণ। রেটিংগুলো মতামত হিসেবে বিবেচিত হয় বলে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ভুল রেটিংয়ের জন্য কোন দায়বদ্ধ নয়। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ তিনটি প্রধান সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১০ ডড-ফ্রাঙ্ক ওয়াল স্ট্রিট সংস্কার ও ভোক্তা সুরক্ষা আইন এবং ২০১১ সালে তৈরি ইউরোপীয় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড মার্কেটস অথরিটি (ঊঝগঅ) , উভয়ই এজেন্সিগুলিকে জবাবদিহি করতে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
লেখক: ব্যাংকার