শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৯:৩৯ অপরাহ্ন
পাপড়ি রাণী রায়
শিক্ষার্থীর মনের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলা, জ্ঞানের আলোয় তাদের অন্তরকে আলোকিত করা, তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এই মহান দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষকের। শিক্ষকগণের সুচিন্তিত নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
শিক্ষকের প্রদর্শিত জ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা নতুন জীবন লাভ করে। তাই তো শিক্ষকতা কখনও একটা চাকরি নয়, এটি একটি মহান ব্রতের আদর্শ পেশা। শিক্ষার্থীর শিক্ষার যথাযথ এবং মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা বহুলাংশেই শিক্ষকের ভূমিকার উপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে শিক্ষকের মহৎ সাহচর্য, নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার সাধনায় ব্রতী হয়। নিজের জীবন বিকাশ, সদগুণাবলি অর্জন এবং ব্যক্তিত্বের জাগরণ শিক্ষকের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল।
মা-বাবা সন্তান জন্ম দেন কিন্তু মানুষ হিসেবে শিক্ষকই গড়ে তোলেন। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত শিক্ষকের মর্যাদা কবিতায় আমরা জেনেছি, মহান স¤্রাট আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি মর্যাদাবোধ। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব মর্যাদা রয়েছে। এ মর্যাদা প্রাণের চেয়ে বড়। একজন শিক্ষকের মর্যাদা অন্য সবার উপরে।
মা-বাবার পর শিক্ষকই একজন ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় মা-বাবার মর্যাদার স্থান পায়। তার মূলে রয়েছে ছাত্রের জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভূমিকাই বিশেষ কার্যকর হলেও ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা ও অবস্থানের উপর ঐ সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে এবং এ সম্পর্কটি মধুর ও পবিত্র হলে তার ভিত্তিতেই ছাত্রের ভবিষ্যৎ জীবন সার্থক ও মহিমান্বিত হয়ে উঠে।
বাবা মায়ের পরে শিক্ষকই দ্বিতীয় মা-বাবার মর্যাদায় আসীন হন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষকের সঠিক ও যথাযথ দিকনির্দেশনা শিক্ষার্থীর জীবনকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। শিক্ষকের সংস্পর্শে না এলে শিক্ষার্থীর জীবন কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না।
একজন মানুষের জীবন কখন পরিপূর্ণতা পায়। পরিপূর্ণতা বলতে বোঝায় জীবনের বিকাশ, ব্যক্তিত্বের জাগরণ ও তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। এই যে, ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে শিক্ষকের পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যাবসায় শিক্ষার্থীর মনের খোরাক বাড়াতে সাহায্য করে।
শিক্ষক তাঁর মেধা দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে প্রচন্ড কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নান বাট দৌজ হু হেড দ্যা স্প্রিট অফ ফরবারেন্স আর ফিট টু বি ব্যাচেলর।’ কৌতূহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থের ভূমিকা প্রধান নয়। এটা সত্য যে, শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফি দিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষকও জীবিকা নির্বাহের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেতন পেয়ে থাকেন। অর্থ দিয়ে কখনও বিদ্যাদানের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। শিক্ষক একজন যোগ্য ছাত্র গড়ে তোলায় যে আনন্দ পান, ছাত্রের কাছ থেকে যে সম্মান পান, অর্থ দিয়ে কি সেই আনন্দ পাওয়া যায়- অপরদিকে শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে যে জ্ঞান লাভ করে অর্থ দিয়ে তার মূল্য কখনও পরিশোধ হবে না।
প্রাচীন ঐতিহ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। জাগতিক সমস্ত জ্ঞানের শিক্ষা গুরুগৃহ থেকেই শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতো। শিক্ষাগুরুর সেবাযতেœর মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে শিক্ষার্থী জীবনকে ধন্য মনে করতো। শিক্ষা গুরুর সেবাযতেœর কাজ পূণ্যের কাজ মনে করা হতো। প্রাচীন ভারতে, গ্রিসে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে এভাবে এক অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে উঠতো।
সেই ঐতিহ্যের আদলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিক্ষক হচ্ছেন ছাত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসপার এন্ড গাইড। ছাত্রের ভবিষ্যৎ চলার পথকে সুগম করে দেন বলে তিনি গাইড বা পথপ্রদর্শক।
বিশ্বকবি তাই ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্ককে বিচার করেছেন পরস্পর নির্ভর, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক হিসেবে, সে সম্পর্ক কেবল পুঁথিগত বিদ্যা শেখানো ও শেখার সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ নয়।
আধুনিককালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রচলন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সুদূর অতীতের সুসম্পর্কের দিনগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে। অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় অনাচার প্রবেশ করেছে। খবরের কাগজে হৃদয় বিদারক ঘটনা প্রকাশ পায়। শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, শিক্ষককে মেরে ফেলা! অযথা হেনস্থা করা। এসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। সন্ত্রাসী তৎপরতায় আজকাল শিক্ষাঙ্গন কলুষিত।
‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় শিক্ষকের মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বাদশাহ আলমগীরের ছেলের দ্বারা পায়ে পানি ঢেলে নিয়েছিলেন। বাদশাহ আলমগীর প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁর সন্তান পানি ঢেলে নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুলে দেবেন। তবেই না তার সন্তান নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম নিয়ে দেশের একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, শিক্ষা হলো একটি জাতির মেরুদ-; আর শিক্ষক হলেন কা-ারি। সমাজ ও দেশের জন্য শিক্ষকের অবদান অপরিসীম। তাই শিক্ষকের মর্যাদা সমাজে সবার উপরে।
শিক্ষক যেহেতু জ্ঞান প্রদীপ জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন, কাজেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবমাননা, অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে করে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক ঘটনা না ঘটে। শিক্ষার্থীদের পারিবারিক শিক্ষাটা এখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এর ভিত্তিটা জাগ্রত হলে অনাচার মুক্ত হবে।
একটি কথা না বললেই নয়, শিক্ষককে অবশ্যই হৃদয়গ্রাহী হতে হবে। আন্তরিকতার সহিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমার দৃষ্টিকোণে শিক্ষকতা পেশাটি চাকরি নয়, এটি একটি মহান পেশা। আদর্শ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে দেবতুল্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি মেনে নিয়ে সুন্দর পরিবেশে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে মূলত হবে আত্মার এক নিবিড় বন্ধন। এভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করা বা সেই শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনতে পারলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে উন্নতি হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পরস্পর সমঝোতা না হলে বিদ্যার্জনের সাধনা সার্থক হয় না। সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপ থেকে মুক্ত রাখা চাই।
পরিবেশ সুন্দর হলেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরস্পরের কাছাকাছি আসলে এবং তাতে অনাবিল সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হলেই পঠন পাঠনের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত হবে। শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করলেই জীবনে যোগ্য হওয়া যায়। আর শিক্ষককে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা চাই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এভাবে সুসম্পর্ক বজায় থাকলেই শিক্ষাদান ও গ্রহণ সার্থক হবে, পরবর্তীতে জাতি লাভ করবে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট।