ফিরে আসা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৩৬:১৭ অপরাহ্ন
মুন্সি আব্দুল কাদির
রহিম সাহেব খুব অসুস্থ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। পাশে বসা স্ত্রী তানজিনা শুভ্রা ও একমাত্র ছেলে তারিক শুভ। পিতা-মাতা দুজনই ছেলেকে শুভ বলে ডাকে। ডাক্তারদের পরীক্ষা নীরিক্ষা, ঔষধপথ্য কোনটিরই কোন কমতি নেই। তবু রোগের কমতি নেই। রহিম সাহেবের মনতো বিষন্ন। সাথে স্ত্রী ছেলেও মন খারাপ করে বসে আছে। কী করবে কোন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। ডাক্তাররা তাদের মত করে অভয় দিচ্ছেন, আশার বাণী শোনাচ্ছেন। কিন্তু রোগ না সারলে আর কত দিন চিন্তামুক্ত থাকা যায়!
রহিম সাহেব তার জীবন নিয়ে ভাবছেন। একে একে জীবনের প্রত্যেকটি অলিগলি তার সামনে উপস্থিত। ভিডিও চিত্রের মত এক একটি সামনে আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। এই হারিয়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া নয়। প্রত্যেকটি চিত্র তাকে নাড়া দিচ্ছে। এই জীবনের জন্য তিনি করেননি এমন কাজ নেই। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, বৈধ অবৈধের দিকে কোন তোয়াক্কা করেননি। এই জীবন সাজানোর জন্য, সংসার সাজানোর জন্য সবই করেছেন। জীবন সাজানো বলতে আমরা আজ অর্থ কামাইকেই বুঝে থাকি।
এই অসুস্থতা তাকে অনেক ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। অনেক সময় কোন মানুষ অসুস্থ হলে, বিপদে পড়লে সে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগ সেরে গেলে বিপদ মুক্ত হলে আবার আল্লাহকে বেমালুম ভুলে যায়। রহিম সাহেব স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলেন, শুভ্রা আজ দেখছি জীবনে শুধু ভুল আর ভুল করেছি। আজ আমি অসুস্থ আমার সম্পদ চিকিৎসায় খরচ হচ্ছে, তোমরাও কষ্ট করে যাচ্ছ। কিন্তু আমি ভাল হচ্ছি না। আসলে আমি তো আল্লাহর জন্য (প্রকৃতপক্ষে নিজের ভালর জন্য) কোন কাজ করি নাই। শুধু চাই শুধু খাই এই দুটোতে জীবনভর ব্যস্ত ছিলাম। আমি আজ বুঝতেছি কী যে ভুল করেছি। আমাকে আল্লাহ দিকে ফিরে আসতে হবে। হে আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করো। শুভ্রা, আমি ভাবছি আল্লাহ আমাকে সুস্থ করলে আমি নামাজ ছাড়ব না। হজ করতে যাব। তোমার কী মত?
হ্যা আল্লাহ সুস্থ করুন। তারপর আমরা সবাই মিলে হজ্জে যাব। আমরা তো নিজের কাজ করছি না। পরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই টাকা পয়সা কোনটাই তো আমাদের সাথে যাবে না। অথচ এই টাকা টাকা করেই জীবন শেষ করছি। এই আমাদের এত টাকা কই রোগ সারাতে পারছে না। ডাক্তার শুধু আশা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সেই আশা নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। টাকা খরচ করছি। আসলে তোমার এই রোগ আমাদের জন্য ও শিক্ষা।
মা বাবার কথায় ছেলে নির্বাক তাকিয়ে শুনতে থাকে। স্ত্রীর এই কথায় রহিম সাহেবের খুশি হওয়ার পরিবর্তে মন একটু বিষন্ন হয়ে গেল। স্ত্রী বলেন, কী হল, শরীর খারাপ লাগছে? হ্যা একটু খারাপ লাগছে। আবার একটু ভাবনাও এসেছে রহিম সাহেব জবাব দেন। রহিম সাহেব বলেন, সবাই মিলে হজে যাব এটাতো খুশির কথা। কিন্তু টাকা পাব কোথায়? রহিম সাহেবের স্ত্রী পুত্র দুজনই আশ্চর্য হয়ে রহিম সাহেবের দিকে চেয়ে থাকে। তাদের প্রশ্ন তাদের ঢাকায় কয়েকটি বাড়ি, ব্যাংকে জমানো কোটি টাকা, আরো কত সম্পদ। এত টাকা থাকতে তিনি বলেন টাকা পাবে কোথায়! ছেলে বাবাকে বলে, বাবা আপনি এ কী বলছেন। রহিম সাহেব বলেন, আমার কথা বলতে যদিও কষ্ট হচ্ছে, তারপরও আমাকে বলতে হবে। হ্যা বাবা আমি যত সম্পদ কামাই করেছি। হালাল হারামের কোন তোয়াক্কা করিনি। আমার গড়া সম্পদ কোনটাই পুরোপুরি হালাল নয়। চাকুরীতে ঘোষ খেয়েছি। চাকুরীর সাথে ব্যবসা চালাতে গিয়ে কাজে ফাঁকি দিয়েছি। ব্যবসায় মানুষকে ঠকিয়েছি। এই টাকা দিয়ে হজ করলে, আমার তোমাদের হজ কবুল হবে না। আল্লাহর দিকে যখন ফিরেই আসব তখন হারাম দিয়ে কী করে হজ করি। একমাত্র তোমার দাদার রেখে যাওয়া গ্রামে যে অল্প জমি আছে সেটি বিক্রয় করে একজনের হজ করা সম্ভব, বাকি সকলের হজ কিভাবে হবে আমি এই চিন্তাই করছি।
তিনজনেরই মুখ মলিন। চেহারায় চিন্তার ছাপ। ছেলে মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছে। ভাবনার মধ্যে মায়ের দিকে চেয়ে বলে। মা তোমরা যে আমাদে পড়িয়েছ। উচ্চশিক্ষিত করেছ। এতে অনেক খরচ হয়েছে। এখনও আমার কোন কিছুর অভাব হতে দাও না। সব সময় আমাকে আগলিয়ে রাখ। একটু চিন্তা করে দেখতো আমার বড় হওয়া, লেখাপড়া করা সব কিছুতেই তো হারাম মিশে আছে। আগে আমি নামাজও পড়তাম না। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর যখন কোন কিছুতেই বাবা অসুখ কমছে না। তখনই আমি আমার বন্ধু আরিফের কথায় নামাজ শুরু করলাম। আগে টাকার গরম দেখাতাম। আর এখন আল্লহর উপর নির্ভরতা দেখাই। আগে মনে আনন্দ থাকলেও প্রশান্তি পেতাম না। এখন সত্যি আমি মনে অনেক প্রশান্তি পাচ্ছি। আব্বার অসুস্থতার কথা আল্লাহকে বলতে পারছি। বাবার সুস্থতার জন্য দোয়া করতে পারছি। বাবা সুস্থ হওয়ার পর এই হারাম থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় আমরা তিন জন মিলে চিন্তা করা দরকার। আমরা যদি এই চিন্তা করে মহান আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করি, আব্বার সুস্থতার জন্য দোয়া করি আমার মন বলছে, আব্বা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। ছেলের কথার পর ছেলে সহ তিন জনই একসাথে বলে উঠেন আমীন।