নবীজীর পরিবারবর্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮:২১:২২ অপরাহ্ন
মো. আব্দুশ শহীদ নেগালী
আঁধারের বুক চিরে মহামুক্তির পয়গাম নিয়ে ৫৭০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় এ পৃথিবীতে তশরিফ আনেন ছরওয়ারে কায়েনাত, নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। মহান রাব্বে করীম তাঁর কালামে পাকে তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অসীম মান মর্যাদা ও চারিত্রিক গুণাবলি বর্ণনা পেশ করেছেন অনেক আয়াতে। গুণীজনের কলমে কত সাহিত্য রচিত হয়েছে প্রিয় নবীর শানে। কবিদের কবিতায়, শিল্পীদের কন্ঠে নবীর শান উচ্চারিত হচ্ছে হর হামেশা। সকল ধর্মের মানুষ প্রিয় নবীকে চিনতে আর বাকি নেই। যিনি রাহমাতুল লিল আলামীন, শাফিউল মুযনিবীন তাঁর পরিবার পরিজন, সন্তান-সন্ততী, পূর্ব পুরুষ কারা ছিলেন তাদেরকে পরিচয় করতে আগ্রহ কার নেই। তাফসির ও সিরত গ্রন্থ সমূহে তাদের পরিচিতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
প্রিয় নবীর পয়দাইশের মাসে কিছুটা রহমত ও বরকত লাভের আসায় তাদের পরিচিতি সংক্ষেপে পেশ করছি। রাসূল (সা.) এর সম্মানিত পিতার নাম হচ্ছে হযরত আব্দুল্লাহ (রা.), মাতার নাম হচ্ছে হযরত আমিনা (রা.)। তারা উভয় ছিলেন কুরাইশ বংশীয়, তবে মাতাকে বলা হত জুহরী বংশীয়। জুহরী ছিলেন কুরাইশের অধঃস্তন মদিনায় বসবাসকারী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
দাদার নাম হচ্ছে- শাইবাতুল হামদ। উপনাম আব্দুল মুত্তালিব। দাদীর নাম- ফাতেমা বিনতে আমর। নানার নাম- ওহাব। নানীর নাম- বাররাহ বিনতে আব্দুল উজ্জা।
তৎকালীন আরব বিশ্বে কুরাইশ বংশ ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। জ্ঞানে-গুণে প্রভাব প্রতিপত্তি, আচার ব্যবহার, আর মান মর্যাদার দিক দিয়ে কুরাইশ বংশের সমকক্ষ কেহ ছিল না। আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রাসূল (সা.) এর পরদাদা হযরত হাশীম তাঁর উঠগুলি জবাই করে রুটির সাথে রান্না করে এলাকা খাবাতেন। যুগ যুগ ধরে পবিত্র কাবা শরীফের দায় দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন একমাত্র কুরাইশগণই। রাসূল (সা.) এর পূর্ব পুরুষ আদনান, যিনি সর্ব প্রথম কা’বা শরীফের গিলাফ পরিয়েছিলেন। নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে শুভ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যারা উম্মাহাতুল মু’মিনীন (মুমিনগণের মাতা) এর মর্যাদা লাভ করেছিলেন সে সকল পুণ্যবতি নবী সহধর্মিনীগণের নাম নি¤েœ পেশ করছি।
প্রিয় নবী (সা,) ২৫ বছর বয়সে সর্বপ্রথম বিয়ে করেন ৪০ বছর বয়সি হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) কে। যিনির পিতার নাম ছিল খুযাইলিদ। হযরত খাদিজা (রা.) জীবিত থাকা অবস্থায় হযরত নবী করীম (সা.) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।
২য় স্ত্রী হযরত সাওদা (রা.) পিতার নাম জামআ।
৩য় স্ত্রী হযরত আয়শা (রা.) পিতার নাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)
৪র্থ স্ত্রী হযরত হাফছা (রা.) পিতার নাম হযরত ওমর (রা.)
৫ম স্ত্রী হযরত যয়নব (রা.) পিতার নাম আজিমা
৬ষ্ঠ স্ত্রী হযরত যয়নব (রা.) পিতার নাম জাহাস
৭ম স্ত্রী হযরত উম্মে হাবীবা (রা.) পিতার নাম হযরত আবু ছুফিয়ান (রা.)
৮ম স্ত্রী হযরত উম্মে ছালমা (রা.) পিতার নাম আবু উম্মিয়া
৯ম স্ত্রী হযরত মায়মুনা (রা.) পিতার নাম হারেস
১০ম স্ত্রী হযরত সাফিয়া (রা.) পিতার নাম হাই
১১তম স্ত্রী হযরত যুয়াইরিয়া (রা.) পিতার নাম হারেস
তাছাড়া রাসূল (সা.) এর দুই জন দাসী ছিলেন ১ জনের নাম মারিয়া কিবতিয়া এবং অপর জনের নাম রায়হানা।
রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণের মধ্যে একমাত্র হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন কুমারী। অবশিষ্ট সকল ছিলেন বিধবা।
বিশ্বনবীর সন্তানগণ
১। হযরত যয়নব (রা.) ২। হযরত রুকেয়া (রা.) ৩। হযরত উম্মে কুলছুম ৪। হযরত ফাতেমা (রা.) কন্যা ছিলেন ঐ চার জন।
হযরত যয়নব (রা.)কে বিবাহ দিয়েছিলেন তার খালাত ভাই আবুল আছ ইবনে রবির সাথে।
হযরত রুকেয়া ও হযরত উম্মে কুলছুম (রা.)কে সর্বপ্রথম আবুলাহাবের দুই পুত্রের কাছে বিবাহ দিয়েছিলেন। আবুলাহাবের বিপক্ষে যখন সুরালাহাব নাযীল হয় তখন সে স্তব্ধ হয়ে রাসূল (সা.) এর উভয় মেয়েকে তালাক দিবার জন্য তার দুই ছেলেকে নির্দেশ দেয় এবং তার কথায় তারা তালাক দিয়ে দেয়। রাসূল (সা.) এর ঐ কন্যাদ্বয় ছোট থাকায় তাদের সাথে বাসর ঘর হয়নি। ওরা পবিত্রা থেকে যান।
পরবর্তীতে হযরত ওসমান (রা.) এর সাথে বিবাহ দেন হযরত রুকেয়া (রা.)কে। বদর যুদ্ধের সময় হযরত রুকেয়া ইন্তেকাল করলে। পরবর্তীতে হযরত উম্মে কুলছুম (রা.)কে হযরত ওসমানের সাথে বিবাহ দেন। হযরত ওসমান (রা.) রাসূল (সা.) এর দু’কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন বলে ওসমান যিন নূরাইন (ওসমান দু’নূরের অধিকারী) উপাধি লাভ করেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি আল্লাহর নির্দেশে আমার মেয়ে উম্মে কুলছুমকে ওসমানের সাথে বিবাহ দিয়েছি।
হযরত ফাতেমা (রা.)কে বিবাহ দিয়েছিলেন হযরত আলী (রা.) এর সাথে। ঐ হচ্ছে নবী করীম (সা.) এর ৪ কন্যা ৩ জামাতা। হযরত নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমি আমার মেয়ে ফাতিমার নাম রেখেছি আল্লাহর নির্দেশে।
সম্মানিত পুত্রগণ
১। হযরত কাছেম (রা.) ২। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) ৩। হযরত ইব্রাহীম (রা.)। ঐ তিনজন শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। নবী করীম (সা.) এর ৭ জন সন্তান সন্ততির মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (রা.) ব্যতিত বাকী সকল ছিলেন হযরত খাদিজা (রা.) এর গর্ভজাত। অপর দিকে হযরত ইব্রাহীম (রা.) ছিলেন মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভজাত।
মহানবী (সা.) এর আহলে বাইত
একটি অভিমতে আহলে বাইতে বলতে হযরত ফাতেমা (রা.), হযরত আলী (রা.) হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হুসাইন (রা.) বলা হয়।
অপর অভিমতে উপরোক্ত ৪ জন সহ মহানবীর স্ত্রীগণকে আহলে বাইত বলে। উপরোক্ত সকলকে আহলে বাইত বললে ভুল হবে না।
মহানবীর চাচাগণ
হযরত আব্দুল মুত্তালিব মান্নত করেছিলেন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যদি আল্লাহ তায়ালা তাকে ১০ জন সন্তান ছেলে দান করেন তাহলে একজনকে পবিত্র কা’বা শরীফের সামনে কুরবানি করবেন। মহান আল্লাহ পাক তাকে একে একে দশজন সন্তান দান করলেন। বালির নিচে গাইব হয়ে যাওয়া যম যম কূপ ঐ দশজন সন্তানকে নিয়ে খনন করেছিলেন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব। তারা হলেন- ১। হারিস ২। যুবাইর ৩। হজল ৪। দরার ৫। মাকউম ৬। আবুলাহাব ৭। আব্বাস ৮। হামযা ৯। আবু তালিব ১০। আব্দুল্লাহ। যিনি রাসূল (সা.) এর পিতা। বাকী নয়জন হলেন তিনির আপন চাচা।
মহানবী (সা.) এর নসব নাম (পূর্ব পুরুষগণ)
প্রিয় নবী (সা.) এর পূর্ব পুরুষ কেহ মুশরিক ছিলেন না জালিয়াতের কুসংস্কার থেকে আল্লাহ পাক তাদেরকে পবিত্র রেখেছিলেন। এজন্য মাঝে মধ্যে রাসূল (সা.) তাঁর বংশ নিয়ে গর্ব করতেন। কা’বা শরীফের মতওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন প্রিয় নবী বংশধরেরা। দূরদেশ থেকে চলে আসা হাজীগণের পানহারের ব্যবস্থা তারাই করতেন। মেসবানিতে প্রিয় নবীর পূর্ব পুরুষরাই ছিলেন অদ্বিতীয়। তাদেরকে এক আল্লাহ বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদায় বলা হত। পাঠকগণের জ্ঞাতার্থে বলছি প্রিয় নবীর নসব নামায় যে ইবনে, শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে এ ইবনে শব্দের পূর্বের নামটি হবে ছেলের এর পরের নামটি হবে পিতার।
পবিত্র নসব নামা হচ্ছে, সাইয়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.) ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাসিম ইবনে আবদে মনাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুন্না ইবনে কাব ইবনে লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নাদার ইবনে কেনানাহ ইবনে খুজাইমা ইবনে মুদরিকাহ ইবনে ইলিয়াছ ইবনে মুদার ইবনে নাযার ইবনে সা’দ ইবনে আদনান ইবনে আদ ইবনে আরদ ইবনে মাকুম ইবনে নাখির ইবনে তিবরাহ ইবনে ইয়ারব ইবনে ইয়াতত্তাহির ইবনে ছাবিত ইবনে কায়দার ইবনে ইসমাইল (আ.) ইবনে ইব্রাহীম (আ.) ইবনে তারুখ ইবনে নাখুর ইবনে মারুহ ইবনে রাউ ইবনে ফালিহ ইবনে উবায়র ইবনে শামলুুখ ইবনে আরফাহশাদ ইবনে শাস ইবনে নূহ (আ.) ইবনে লামক ইবনে মুতাওয়াশালাহ ইবনে আখুন (ইদরিস আ.) ইবনে ইয়ারিদ ইবনে মিহলিন ইবনে কাইনান ইবনে ইয়াইশ ইবনে শীশ (আ.) ইবনে আদম (আ.) দুরুদ ও সালাম তার উপর এবং বংশ পরম্পরায় যে সকল নবী রয়েছেন তাদের উপর।
রাসূল (সা.) ৪র্থ পুরুষ আবদে মনাফের দুই পুত্র ছিল। একজনের নাম আবদে শামছ, তার বংশধরের নাম্ উমাইয়া এবং অপর জনের নাম হাশিম, তার বংশধরের নাম হাশিমি বলা হত। বিশ্ব নবী (সা.) এর উর্ধ্বতন ১১নং পুরুষের নাম ফিহর। এ ফিহরের অপর নাম কুরাইশ। কুরাইশ বলা হত সমুদ্রের সবচাইতে বড় একটি প্রাণীকে। যাকে কেউ পরাজিত ও খেয়ে ফেলতে পারে না। আবার এ প্রাণী অন্য সকল প্রাণীকে খেয়ে ফেলতে পারে। অনুরূপভাবে কুরাইশ বংশকে কখনও কোন প্রতিপক্ষ পরাজিত করতে পারত না আবার কুরাইশরা তার প্রতিপক্ষকে সহজে পরাজিত করতে পারত। কুরাইশ বংশীয় সকল গোত্রের মধ্যে হাশিমী গোত্র ছিল তৎকালীন শিক্ষা দিক্ষায় ধন-দৌলতে ও মান মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ।
লেখক : শিক্ষক।