অদম্য মেধাবী---
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুবুর এখন বিসিএস ক্যাডার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৪:৪৫:০৭ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
জীবনের পদে পদে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। চোখের আলো না থাকা সত্ত্বেও নিজের কাছে নিজেই প্রতিশ্রুতিবন্ধ হয়েছিলেন, কখনো না হারার। এজন্যেই হয়তো জীবনযুদ্ধে, কখনো হারেননি। অসাধ্যকে সাধ্য করা সিলেটের সেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুবুর রহমান ৩৪তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। মনের জোরে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সিলেটের শাহপরান বাহুবল আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমানের বাবা হাকিম মো. সাদ উল্লাহ বাচ্চু এবং মা রাবেয়া খানম রুবি। পরিচিত মহলে রনি নামেও পরিচিত। পরিবারে মা-বাবা ছাড়াও মাহবুবুর রহমান রনির রয়েছেন ছোট আরো তিন বোন। যে বোনরা মাহবুবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের শক্তি, সাহস, অনুপ্রেরণা। বলা যায়, তাদের অতুলনীয় আন্তরিকতার জন্যেই আজকের মাহবুবুর রহমান।
জন্মের পরপরই রনির চোখের সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠে মা-বাবার কাছে। তারপরও চিকিৎসা জন্য দেশের বাইরে পর্যন্ত যাওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা কোনো সুখবর দিতে না পারলেও নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় আর একনিষ্ঠ সাধনায় শুধু পরিবার নয়, সারাদেশকে তিনি নিজেই সুখবর দিয়েছেন।
এর জন্য অবশ্য তাকে কম কষ্ট পোহাতে হয়নি, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে পদে পদে। শৈশবে স্থানীয় এক হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছিল মাহবুবুর রহমানকে। এরপর আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, ঢাকার মিরপুর ১৪ নম্বরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বর্তমানে সিলেটে ব্রেইলের পাঠ্যপুস্তক সহ সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্পের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তখন সিলেটে সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে স্কুল ছিল না। অবশ্য সেসময় মৌলভীবাজারে বিদ্যালয়ে ছিল। ২০০৫ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন সেই স্কুল থেকে। মানবিক বিভাগ থেকে তার ফল ছিল জিপিএ-৪.৮৮। তবে স্কুল মাদরাসায় ভর্তির আগে বাসায় যখন সময় কাটছিলো; তখন মা রাবেয়া খানম রুবি তাকে ভর্তি কারিয়ে দেন আবৃত্তি আর গানের ক্লাসে।
২০০৫ সালে এসএসসির পর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য ভর্তি করা হয় সিলেট জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ২০০৭ সালে জিপিএ-৪.৪০ পেয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। প্রতিটি ভালো ফলাফলের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে মাহবুবুর রহমানকে, মা-বাবাসহ পুরো পরিবারকে। সেসময় ব্রেইলের উন্নত সুযোগ সুবিধা তৈরি না হওয়ায় বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে লেকচার শিট জোগাড় করতে হয়েছে। তারপর ছোট বোনেরা রেকর্ড করে দেয়ার পর তিনি সহজে সেগুলো রপ্ত করে নিতেন। অবশ্য এর পেছনে কিছু শিক্ষকের অবদান এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন রনি।
মনের শক্তির উপর ভর করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন একজন শ্রুতিলেখকের সহায়তায়। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তির সুযোগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এভাবে একের পর এক পরিশ্রম, দিনশেষে সাফল্য দিয়েছে মানুষটিকে।
স্নাতকের শেষ দিকেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। সাথে বিসিএসের প্রস্তুতিও চলছিল। পুরোদমে প্রস্তুতি শেষে ৩৪তম বিসিএসে অংশ নেয়ার সুযোগ আসে। ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মাহবুবুর রহমান ছাড়াও ২০ থেকে ২৫ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অংশ নিয়েছিলেন। শ্রুতিলেখকের সহায়তায় লিখিত পরীক্ষা শেষে চারজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাক্ষাৎকারের ডাক পেয়েছিলেন। তার মধ্যে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সারা দেশের মধ্যে মাহবুবুর রহমান রনি হলেন সেই সৌভাগ্যবান, যিনি প্রথম নিয়োগ পাওয়া মানুষ।
মাহবুবুর রহমান জানান, ‘যে দিন ৩৪তম বিসিএসের সাক্ষাৎকার দিয়ে আসি, সেদিন রাতেই নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলো থেকে একটি মেইল পাই। তারা জানায়, আমি এমফিল করার সুযোগ পেয়েছি। এক ধরনের দোটানায় পড়ে যাই। বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময় যেহেতু তখনো ঠিক হয়নি, তাই আমার শিক্ষকেরা তখন পরামর্শ দিলেন নরওয়ে যাওয়ার। নরওয়েতে আমার এমফিলের বিষয় ছিল বিশেষ শিক্ষা।
সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক থাকা অবস্থায় শিক্ষাছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন মাহবুবুর রহমান। সেখানকার বোস্টন কলেজে পাঠক্রম শিক্ষাদান বিষয়ে এমএড সম্পন্ন করার সুযোগটাও হাতছাড়া করেননি।
বিসিএস শেষে ২০১৬ সালে সিলেটের চুনারুঘাট সরকারি কলেজে যোগ দেন রনি। ইউনিভার্সিটি অব অসলোতে তখনো একটি সেমিস্টার অসম্পন্ন ছিল। চুনারুঘাটের কর্মস্থলে ছয় মাস কাটানোর পর শিক্ষামন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন সেমিস্টার সম্পন্ন করার জন্য। ছুটি পেয়ে সেই সুযোগটা কাজে লাগান। এরপর এসে যোগ দেন সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। অবশ্য তার প্রথম চাকরি ছিল স্নাতকোত্তর শেষ করার পর সহযোগী শিক্ষক হিসেবে সরকারি প্রকল্পের অধীনে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি স্কুলে।
হিসেবের অংক বলছে, শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে একটি সময়ও হেলায় নষ্ট করেননি মাহবুবুর রহমান। প্রতিটি সময়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে সময় এবং ভাগ্য তার পক্ষেই ছিলো।
অনেক সুযোগ সম্ভাবনার পর এখনো বসে নেই রনি। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন শেষে এখন বেশ কিছু গবেষণায় হাত দিয়েছেন। সেই গবেষণা সমাজের অন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য, তাঁদের কর্মসংস্থানের জন্য। এক্ষেত্রে দরকার সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের সহযোগিতা। সবার সহযোগিতা পেলে তাঁর গবেষণা, তাঁর পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে একদিন।
শিক্ষাকতা, গবেষণার পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এগিয়ে নিতে গঙ্গাপদ্মা শিল্পীগোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে তুলেছেন মাহবুবুর রহমান রনি।
নিয়মিত চলছে সেই সংগঠনের কার্যক্রম। লিখেছেন অনেকগুলো নাটক। একটি নাটক এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফএমে প্রচারিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সেই সংগঠনের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন।
সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থী নাদিরা সুলতানা, সজিব চন্দ ও মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘স্যার আমাদের আদর্শ, আমাদের অনুপ্রেরণা। স্যারকে পাওয়ার পর আমাদের জীবনের অনেক ভাবনা বদলে গেছে। কেন জানি মনে হয়, স্যার যদি পারেন, আমরা কেন পারবো না।’
কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. দিদার চৌধুরী বলেন, খুবই মেধাবী মানুষ রনি। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের চেয়েও কয়েকধাপ এগিয়ে তিনি। প্রভাষক সাদিকুর রহমান সাত্তার বলেন, ‘মাহবুবুর রহমান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত। প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।’ এ প্রসঙ্গে কথা হলে সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল সাজিদ জানান, ‘মাহবুবুর রহমান আমাদের কলেজের গর্ব। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করেন। সুযোগ পেলে তাদের জন্য অনেক কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে তার।’