অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৪৭:১৫ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে পর্যটন শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে কোন কোন দেশে জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে এই পর্যটন শিল্প থেকে। এ কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বিদেশীদের কাছে স্বদেশের সৌন্দর্য ও ভাবমূর্তিকে তুলে ধরার সহজ উপায় হল পর্যটন শিল্পের প্রসার। পর্যটনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই বিদেশী ব্যাপক জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকে। এভাবে পর্যটন শিল্পে উন্নত সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ পর্যটন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, পর্যটন শিল্প থেকে বিপুল আয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প সেভাবে গড়ে উঠেনি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ গঠন করা হয়। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও কর্পোরেশন এ খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। এটা কর্পোরেশনের ব্যর্থতা অথবা আন্তরিকতার অভাব কি-না তা সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ বিশেষজ্ঞগণ বলতে পারেন। তবে প্রতি বছরই কর্পোরেশন পর্যটন দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু এ পালন জাতীয় জীবনে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাগণ ভালই জানেন। এভাবে দিবস পালন পর্যটন নীতিমালার মধ্যেই রয়েছে, পর্যটনকে শিল্প হিসাবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ থেকে এটাই মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশে পর্যটন বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এতদিন ধরে পর্যটন সম্পর্কে বিভিন্নভাবে প্রচার চালালেও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যা কি-না সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, সেই পর্যটন নীতি এ যাবত ছিল না। এখন পর্যটন নীতি প্রণীত হয়েছে, সেহেতু এর পরবর্তী বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করা হলে পর্যটনকে শিল্প হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। অথচ একথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, গোটা বাংলাদেশেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের কুয়াকাটা যার সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে সারা বছরই দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসতে থাকেন। এখানকার নারকেল বাগানের আশেপাশে রয়েছে পেয়ারা, লেবু, কুল, কাজুবাদামসহ বিভিন্ন জাতের ফলজ ও ঔষধি গাছ যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে। এছাড়াও প্রাকৃতিক মনোরম ও নয়নাভিরাম জায়গা রয়েছে যে কোন লোক দেখলে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারে না। প্রকৃতির হাতে গড়া সুন্দরবন দেখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা এখনো আসছে। সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণের আকর্ষণ বিশ্বব্যাপী। আকর্ষণীয় স্থান নীলফামারীর নীলসাগর। শীতকালে মনোহারিনী নীল সাগরে সুদূঢ় সাইবেরিয়া এবং তিব্বতের মতো সফেদ তুষার রাজ্য থেকে নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি উড়ে আসে। তাদের কোলাহলে সরব থাকে এ নীল সাগরের তীর। তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বহু দুর্লভ পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় পর্যটকদের দৃষ্টি সেদিকে কেড়ে নিচ্ছে। দেশের প্রায় সর্বত্রই রয়েছে অখ্যাত অবস্থায় ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যেমন-জাতীয় কবি নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন স্থান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, মীর মোশারফ হোসেন, বেগম রোকেয়া সমাধিস্থল এসব সত্যিই দেখার এবং গবেষণার বিষয়। দেশের মানুষই সে সবের পরিচয় রাখে না। উল্লেখ্য, দেশের উত্তরাঞ্চলে অর্থাৎ কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামন থানার ঐতিহাসিক ‘দিল্লীর আখড়া’র খবর আমাদের ক’জন রাখে। অথচ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পাঠে এ আখড়া সম্পর্কে জানা যায় যে, স¤্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ২শ’২৬ একর জমি স¤্রাট জনৈক ফকীরকে দান করেন এবং এ জমির উপর স¤্রাট একটি উপাসনালয় নির্মাণ করে দেন। পরবর্তীকালে এটাই ‘দিল্লীর আখড়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং আজ পর্যন্ত স্থানীয় লোকদের কাছে সে নামেই পরিচিত। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে প্রাচীনকালের হিজল গাছ ঘেরা দিল্লীর আখড়া এখনো স্থানীয় লোকদের আকর্ষণ করছে। কিন্তু হাওর এলাকা বিধায় যোগাযোগের অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মানুষ যেতে পারে না সে স্থানে। অনুরূপভাবে দেশের প্রায় জেলাতেই রয়েছে দর্শনীয় স্থান, রয়েছে ঐতিহাসিক মর্যাদা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। যেমন-পাবর্ত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই, চট্টগ্রামের ফয়েজ লেইক, কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল, কর্ণফুলী নদীর অপূর্ব দৃশ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বান্দরবন, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, মাধবকুন্ড ও হামহাম জলপ্রপাত, জাফলং, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের সৌন্দর্যের লীলাভূমি চা-বাগানগুলো, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, চলনবিলসহ সারা দেশে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। এসব স্থানে যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না থাকায় লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এরপর রয়েছে সিলেটের শাহজালাল, শাহপরান, চট্টগ্রামের বায়জীদ বোস্তামী ও বাগেরহাটের খান জাহান আলীসহ অসংখ্য পীর দরবেশ ও আওলীয়ার মাজার, সিলেটকে বৃটিশদের দখলমুক্ত রাখতে গিয়ে সৈয়দ হাদি ও সৈয়দ মেহদীর মাজার যারা ১৭৮২ সালে আশুরার দিনে বৃটিশদের হাতে শহীদ হন। এ দুই ভাইয়ের মাজার রক্ষণাবেক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মানের জন্য ইতিমধ্যেই সিলেটে একটি বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করে যাচ্ছে যাদের একান্ত আগ্রহ সরকার এ শহীদদের মাজার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসবেন যা একসময় পাক বাংলা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনায় স্থান পাবে।
রাঙামাটি দেশের অন্যতম পর্যটনের আকর্ষণীয় স্থান। এখানে আছে পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু, কৃষি খামার, শুভলং ঝরনা ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য, পেদা টিংটিং রেষ্টুরেন্ট, সাংফাং রেষ্টুরেন্ট, চাকমা রাজার বাড়ি, রাজ বনবিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, জেলা প্রশাসকের বাংলো, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের সমাধি সৌধ এবং উপজাতিপাড়া ও জীবনযাত্রার দৃশ্য। কাপ্তাই লেকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ শুভলং ঝর্ণা ও এর আশপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য কার না মন কাড়ে। বর্ষায় ঝর্ণাটি পরিপূর্ণ রূপ মেলে ধরে। চারদিকে বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়ঘেরা এই ঝর্ণার পানি পতনের দৃশ্য সত্যিই অপরূপ।
পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পর্যটন কর্পোরেশনকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বহু জায়গা রয়েছে যেখানে কৃত্রিম উপায়ে হ্রদ সৃষ্টি করে তাতে নৌ-বিহার ও মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করা যায়। এসব করতে হলে সরকারীভাবে ভূমি দখল করে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরাসরি পর্যটন কর্পোরেশনের অধীনে আনা যায়। অথবা নির্বাচিত স্থানের মালিকদের সমবায় সমিতি গঠন করে প্রকল্পের মাধ্যমেও করা যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করতে হবে। বিশেষ করে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সরকারী ও বেসরকারী খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বেসরকারী উদ্যোগ ছাড়া উন্নয়ন প্রচেষ্টা সফল হয় না। পর্যটন নীতি যদি এই হয় যে, সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাবে, তাহলে দেশে পর্যটন শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করবে, দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি বছরই অধিকহারে পর্যটক আসতে থাকবে। অবশ্য ইদানিং দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারিভাবে আকর্ষণীয় পর্যটন সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে।
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে গেলে দেখা যায়, আমাদের দেশ প্রাচীনকাল থেকে বিদেশীদের কাছে অতি পরিচিত। আরব দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতার কথা এখনো এ দেশের মানুষ জানে। এমনকি বাংলাদেশ সম্পর্কিত ইবনে বতুতার লেখা প্রামাণ্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
পর্যটন শিল্প প্রসারের সাথে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বিধান অপরিহার্য। বিদেশী পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে না। প্রত্যেকেই জীবনের নিরাপত্তা চায়। কিন্তু দুবৃত্তদের কাছে দেশী বা বিদেশীর কোন মূল্য নেই। এরা তাদের নিজেরটা শুধু চায়। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানে কঠোর হস্তে এদের দমন করতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, পর্যটন শিল্প শুধু বিদেশীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবে এমন নয়। দেশের নাগরিকরাও দেশের দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখতে উদগ্রীব হয়। এ থেকেও পর্যটনের আশাতীত হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু প্রশ্ন একটাই-জীবনের নিরাপত্তা আছে কি-না। দেশে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু আগ্রহেচ্ছু ভ্রমণকারী ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চায় না। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের দেশে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে দেশের সর্বত্র অবাধে ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু বর্ষাকালে সর্বত্র যাওয়া যায় না। নৌ-পথে সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকলে ভ্রমণকারীদের বিশেষ অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশে সফর করার জন্য বর্তমান সময় অত্যন্ত সুসময়। দেশের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যও এটা উপযুক্ত সময়। এ সময় বহু ছাত্র-ছাত্রী দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে আগ্রহী হয়। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার দরুন তাদের অভিভাবকগণ এদেরকে যেতে দেন না। অবশ্য এ ব্যাপারে পর্যটন কর্তৃপক্ষ যদি দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ সুবিধা দানসহ বাসের ব্যবস্থা করেন, তাহলে শীত মৌসুমে বহু ছাত্র-ছাত্রী ভ্রমণে উৎসাহিত করতে হবে এবং পর্যটনের আয় অনেক বেড়ে যাবে।
এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। আমাদের পর্যটন সম্পর্কে যতটুকু প্রচার চালানো হচ্ছে, শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল বলেই মনে হয়। পর্যটনের প্রতি দেশবাসীকে উৎসাহিত করার লক্ষে আরো ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন। এ সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন যা পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মূল ভিত্তি। বিষয়গুলোর প্রতি সরকারের বিশেষ করে পর্যটন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।