অন্যদের বাঁচাতে যারা জীবন দেন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৩:৫৫:৩৯ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
সন্ত্রাস, ছিনতাই, তুলে নেওয়া- অপরাধ জগতে এগুলো নিয়মিত উচ্চারিত হয়। এই অপরাধগুলোর সাথে যারা জড়িত, তারা দুর্ধর্ষ অপরাধী। তাদের কারণে কত পরিবারে নেমে আসে অশান্তি, কান্না। এর মধ্যেও কিছু সাহসী মানুষের দেখা মেলে যারা অন্যদের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসেন। অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন দেন তাদের কেউ কেউ। যারা বাঁচেন তারা অন্যদেরও বাঁচাতে চেষ্টা করেন। এরকম সাহসী পরোপকারী এবং বিপদকালের সাহায্যকারীদের জীবন সাফল্যে ভরপুর।
ভিক্টোরিয়া সতো
২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। ভিক্টোরিয়া সতো সান্ডিহুক এলিমেন্টরি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক। হঠাৎ একদিন অ্যাডাম লাঞ্জা কানেক্টিকাটের ওই ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে ২০ শিশুসহ মোট ২৮ জনকে। এই হত্যার তালিকায় অ্যাডামের মাও ছিলেন। ছোট্ট সোনামণিদের বাঁচাবার জন্য ভিক্টোরিয়া বাচ্চাদের বাথরুমে, ক্লাসের আলমারিতে লুকিয়ে রাখেন। অ্যাডাম জোরপূর্বক দরজা খোলে বাচ্চাদের খোঁজতে থাকে। ভিক্টোরিয়া সতো বলেন, বাচ্চারা স্কুলের জিমে চলে গেছে। এরপরই অ্যাডাম ভিক্টোরিয়াকে হত্যা করে। তারপর সে স্কুলে তা-ব চালায়। সে নিজেও আত্মহত্যা করে। ভিক্টোরিয়ার অন্তেষ্টিক্রিয়াতে সবাই মন্তব্য করেন, ভিক্টোরিয়া সন্তানদের জন্য তার জীবন বাজি রেখেছিল।
কেলি ব্রিউস্টার
কেলি ব্রিউস্টার একজন সুন্দরী মহিলা। সেদিন ছিলো ২২ মে, ২০১৭ সাল। ব্রিটেনের ইনডোর স্টেডিয়াম ম্যানচেস্টার অ্যারিনায় অনুষ্ঠান হচ্ছে। হঠাৎ বোমা ফাটলো, বিকট শব্দ হলো। আর্তচিৎকার ও কান্নার রোল পড়লো। এ হামলায় নিহত হন ২২ জন, আহত হন ৬০ জন। নিহতদের মধ্যে ৩২ বছরের কেলি ব্রিউস্টার রয়েছেন। তিনি তার ১১ বছরের ছোট ভাতিজিকে বাঁচাতে গিয়ে দু’জনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অ্যারিনার গ্র্যান্ড কনসার্টে কেলি ও তার ছোটবোন ক্লেলায়ার এবং ভাতিজি হোলি বোথ এক সঙ্গেই ছিলেন। বোম্ব ব্লাস্টের কেলি বোথের সামনে গিয়ে দর্ঁাড়ায়। বোথ আঘাত পেয়েও বেঁচে যায়। কেলি ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
ক্রিস পার্কার সেদিন ইনডোর স্টেডিয়ামের ভিতরে ফ্লোরে ছিলেন। বোমা ফাটার পর তিনি লোকদের বাইরে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেন। সেখানে একটি ছোট মেয়ে ছিল, তার পা ছিল না। তার রক্তাক্ত পা টি শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ভয়াল সেই মুহূর্তে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে স্বামীকে নিয়ে পায়চারি করছিলেন পাওলি রবিনসন। বোমার শব্দ শুনে তিনি দৌড়ে গিয়ে ৫০টি অল্প বয়সের বাচ্চাকে বাইরে বের করে নেন।
কার্লোস অ্যারেডন্ডো
সেদিন ছিল ১৫ এপ্রিল, ২০১৩ সাল। বস্টনে ম্যারাথনের প্রতিযোগিতা চলাকালে বোমা হামলা হলো। ৩ জন নিহত হলো এবং আর প্রায় ২৬৪ জন আহত হন। কিছু মানুষ নিজের জীবনের চিন্তা না করে বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে লাগলেন। কার্লোস অ্যারেডন্ডোর স্মরণে এলো ‘মানুষ মানুষের জন্য’ উক্তিটি। হামলার শুরু থেকেই তিনি উদ্ধার কাজে লেগে যান। জেফ বোমানের পা তখন বোমার আঘাতে জর্জরিত। তখন অ্যারেডন্ডো তাকে কোলে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে দেন। সেদিন ম্যারাথনে এক দম্পতিও উপস্থিত ছিলেন। তারা মানুষের প্রাণ বাঁচানোর পাশের একটি কপিশপ থেকে ন্যাপকিন নিয়ে আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করেন।
ইমরান ইউসুফ
অরল্যান্ডো পালস নাইট ক্লাব অ্যাটাকের নায়ক ছিলেন ইমরান ইউসুফ। সেদিন নাইট ক্লাবের বাইরে গার্ডের দায়িত্বে ছিলেন ইমরান। সিকিউরিটি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ২৯ বছর বয়সী নিরাপত্তা কর্মী ওমর মতিন। হঠাৎ করে ভিতরে গুলির আওয়াজ শোনা গেলো। বাউন্সার ইউসুফ সদর দরজার দিকে দৌড় দিলেন। মতিন তাকে খেয়াল করেনি। সেই সুযোগে ইউসুফ পালস ক্লাবের পিছনের গেইট দিয়ে বন্দী ৬০/৭০ জনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। সিকিউরিটি মতিনের বুলেটের আঘাতে ইতোমধ্যে প্রাণ হারান ৪৯ জন। আহত হন প্রায় ৬৮ জন।
ইউসুফ আরো অনেকের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু সময়ের অভাবে পারেননি। সে রাতে পালস ক্লাবে ৩২০ জন লোক ছিল। পরে পুলিশের গুলিতে মতিন নিহত হন।
লাসানা বেথলি
ঘটনাস্থল ফ্রান্সের হাইপার চেকারের কোশার সুপার মার্কেট। সেদিন ছিল ৭ জানুয়ারি ২০১৫ সাল। অন্যান্য দিনের মতোই সকালের দিকে মার্কেটটি চালু হয়। সেদিনও ভিড় ছিল ক্রেতাদের। হঠাৎ বদলে যায় দৃশ্যপট। গুলির শব্দ ও ভীত মানুষের ছোটাছুটিতে মার্কেট প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। তিন মুখোশধারী তিনদিনে হত্যা করে ১৭ জনকে। ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও সেদিন দেখা গিয়েছিল মানবতা। সেদিন হিরো হয়ে যান সুপার মার্কেটের এক মুদি দোকানের কর্মচারী লুসানা বেথলি। তিনি জীবনবাজি রেখে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচান। বেথলি যখন গুলির শব্দ শোনেন, তখন নিরাপত্তার জন্য অন্য দোকানিদের একত্রিত করে সবাইকে নিয়ে যান মার্কেটের বেসমেন্টের এক কোল্ড স্টোরেজ রুমে। কোল্ড স্টোরেজ রুমে সবাইকে রেখে বেথলি বলেন, তোমরা সবাই এখানে চুপ করে বস। আমি বাইরে যাচ্ছি এবং ফিরে আসবো শীঘ্রই। বেথলি রুমের ফ্রিজার ও আলো বন্ধ করে পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য যায়। লিফট দিয়ে মার্কেটের বাইরে আসতেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে এবং তার হাতে হাত কড়া লাগায়। তিনি পুলিশকে সন্ধান দেন যেখানে আতঙ্কিতরা ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন। পরে পুলিশ বেথলির সাহায্যে ফ্রিজার রুম থেকে ১৫ জন বন্দিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
অ্যালেক্স তেভেজ
সাড়া জাগানো সিনেমা দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস চলছে কলোরাডোর অরোরা শপিংমলের সেঞ্চুরি সিনেমা হলে। ডেইট লাইন ২০ জুলাই, ২০১৭ সাল। হলের ভিতরে মন্ত্রমুগ্ধ ৫০০ দর্শক করতালি দিয়ে এনজয় করছে ছবিটি। কিন্তু হঠাৎ জেমস হোমস ছবির প্রিমিয়ার শো’তে ডেনডার শহরে ঘটলো একটা কা-। জেমস একটা ব্যাকপ্যাকে টিয়ার গ্যাস ও মারণাস্ত্র নিয়ে ঢুকে গেলেন হলের ভিতরে। গ্যাসমাক্স পরিহিত জেমস এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করেন। নিমেষেই লুটিয়ে পড়ে ১২ দেহ। তখন প্রেমিক অ্যালেক্স তেভেজ তার প্রেমিকাকে টেনে তার নিচে নিয়ে আবৃত করে রেখেছিল। অ্যালেক্স গার্লফ্রেন্ডকে বাঁচিয়ে নিজের শরীরে গ্রহণ করে ঘাতক বুলেট। শুধু অ্যালেক্সই নয়, সে সঙ্গে জন লারিমার, ম্যাথু ম্যাক কুইন ও জন ব্লাক তাদের প্রেমিকার জীবন বাঁচাতে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয়। এক পিতা তার কলিজার টুকরা কন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন।
রবার্ট অ্যাঙ্গিল
ইমানুয়েলের হাতে একটা পিস্তল। সে গাড়ি থেকে নেমেই পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে গুলি করে হত্যা করে। ব্রুনেটের চ্যাপেল চার্চ অব ক্রাইস্ট-এর পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আরও ছয়জনকে গুলি করে আহত করে ইমানুয়েল স্যামসন। এই হত্যাকা- ঘটেছে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেনিসির ন্যাশভিলে। রবার্ট অ্যাঙ্গেল স্যামসনের সামনে আরো বেশি খারাপ হয়ে যান। অ্যাঙ্গল স্যামসনের হাত থেকে পিস্তলটি ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। স্যামসন অ্যাঙ্গলের মাথায় ও হাতে আঘাত করতে থাকে। অ্যাঙ্গল নাছোড়বান্দা, কিছুতেই হার মানবে না। স্যামসনের হাত থেকে পিস্তলটি পড়ে যায় এবং তার বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ না আসা পর্যন্ত অ্যাঙ্গল তাকে আটকিয়ে রাখে।
মার্ক ইজ মার্টিন
২০১৭ সালের ১২ আগস্ট। ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিল শহর থেকে মার্কিন গৃহযুদ্ধ সময়ের কনভেডারেট জেনারেল রবার্ট ইলির মূর্তি সরিয়ে নেওয়ায় দক্ষিণপন্থিরা প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। হঠাৎ হয় গাড়ি হামলা। হামলার মূল হোতা শ্বেতাঙ্গ তরুণ জেমস অ্যালেক্স ফিল্ডজুনিয়র। হামলায় নিহত হয় ৩২ বছর বয়সী হিথার হেইরি। হঠাৎ একটি গাড়ি উঠে যায় হেইরির ওপর। বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশে নিহত হেইরির বন্ধু মারিসাব্লেয়ার ও মার্কুইজ মার্টিন হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পাশে থাকা বান্ধবী মারিসা বেঁচে যান। মার্টিন মারিসাকে বাঁচান। মার্টিন যখন দেখেন গাড়িটি তাদের দিকে ছুটে আসছে তখন তিনি দ্রুত মারিসাকে লাইন থেকে সরিয়ে দেন, কিন্তু হেইরিকে সরাতে পারেননি। ততক্ষণে হেইরি অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকেন। ভিতরে বসে থাকা জেমস গাড়িটি মার্টিনের ওপর উঠিয়ে দেন মার্টিনের পা ভেঙ্গে যায়। মার্টিন আহত হলেও তার হবু স্ত্রী মারিসার জীবন বাঁচায় মার্টিন।
জেসুস ক্যাম্পাস
২০১৭ সালের ঘটনা। মঞ্চে গায়ক জেসন অ্যাল্ডিন। গিটারের সুরে ভাসছে লাস ভেগাসের ম্যান্ডেলেবের, বাইরে হাজার হাজার দর্শক। হঠাৎ শুরু হয় মেশিনগানের এলোপাতাড়ি গুলি। সেই কনসার্টে স্টিফেন প্যাডকে ম্যান্ডেলে বের ৩০ তলা থেকে গুলি করে ৫৮ জনকে হত্যা করে। আহত হয় ৫০০ থেকে বেশি। এ হামলার ভিলেন ছিলেন স্টিফেন প্যাডক এবং পুরো লাস ভেগাসের মানুষ ছিল হিরো। তাদের মধ্যে একজন জেসুস ক্যাম্পস। সে হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনিউর সিকিউরিটি গার্ড। সে তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে হত্যাযজ্ঞ বন্ধের চেষ্টা চালায়। তার হাতে ছিল না কোনো অস্ত্র কিন্তু সে জানতো বন্দুকধারী প্যাডকের হাতে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। ক্যাম্পস প্যাডকের রুম খুঁজে বের করে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। প্যাডক ভিতর থেকে দরজায় গুলি চালায়। ক্যাম্পসের পায়ে গুলি লেগে রক্ত বের হয়। স্পেশাল পুলিশ ‘সোয়াত’কে দেখিয়ে দেয় প্যাডকের অবস্থান। ক্যাম্পস বন্দুকধারীদের থামাতে পারেনি, কিন্তু কিছু সময়ের জন্য তার দিকে ব্যস্ত রাখেন প্যাডককে। তাতেই বেঁচে যান অনেক মানুষ।
রয় লার্নার ও ইগনাসিও ইচিভেরিয়া
৩ জুন, ২০১৭। সন্ত্রাস যেন পিছু ছাড়ছে না ব্রিটেনের। হঠাৎ কেঁপে উঠেছিল লন্ডন ব্রিজ। লন্ডন ব্রিজ থেকে একটি ভ্যান হঠাৎ উঠে যায় ফুটপাথে থাকা পথচারীদের ওপর। ভ্যানে থাকা তিন আততায়ী ভ্যান ছেড়ে নেমে পড়ে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছুরি। তারা পাব রেস্টুরেন্ট এবং বারে ঢুকে এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে থাকে। এক ফুটবলপ্রেমী রয় লার্নার তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। অসহায় নারীদের বাঁচাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাঁকেও হত্যা করে।
সারা দুনিয়ায় সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে গেছে। দুস্কৃতকারী সমাজ বিরোধীরা যেন পৃথিবীতে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করতে চায়। দেশে দেশে তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক বন্যার সময় বন্যার পানিতে বাড়িঘর যখন ডুবুডুবু অবস্থা, যখন বাড়িতে পানি, মানুষের এই বিপদের সময় ডাকাত-সন্ত্রাসীরা বাড়িঘরে আক্রমণ করেছে, ডাকাতি করতে চেষ্টা করেছে। শুধু পুলিশ দ্বারা এদের প্রতিরোধ করা যাবে না, শায়েস্তা করা যাবে না, আল্লাহ এদের দৌরাত্ম থেকে আমাদের হিফাজত করো।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।