বিশ্ব প্রবীণ দিবস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ৩:৩৪:২৭ অপরাহ্ন
বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র। – আল হাদিস।
অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে এক সময় যারা সমৃদ্ধ করেছেন সমাজ-সংসার, জীবন সায়াহ্নে এসে আজ তারা যেন স্থবির, নিজের কাছেই নিজেকে মনে হচ্ছে যেন বোঝা। সময় চলে তার আপন গতিতে। সময়ের সঙ্গে সম্মুখে চলতে থাকে মানুষের জীবনও। এভাবেই চলতে চলতে বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে আসে মানবদেহ। তখন তাকে লড়তে হয় নিজের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, শরীরের সঙ্গে। মানুষের জীবনের এই চ্যালেঞ্জিং সময়টিই হচ্ছে বার্ধক্য। বার্ধক্যে উপনীত সমাজের এই প্রবীণদের জন্যই আজকের দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে পরিচিত প্রবীণরা সমাজের গুরুজন। বিদ্যমান সভ্যতা-প্রগতি সবই গড়ে ওঠেছে প্রবীণদের হাতে। আর প্রবীণদের উত্তরাধিকার হচ্ছে নবীনরা। প্রবীণদের যথাযথ সম্মান দেয়া, তাদের শারীরিক-মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। জীবন-বাস্তবতার তাগিদে আমাদের ঐতিহ্য একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। এর শিকার হচ্ছেন পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিরাই। এই প্রেক্ষাপটে আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস।
চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা। ১৯৭৪ সালে যেখানে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা ছিলো ৪১ লাখ, এখন তা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখের ওপরে। একটা দেশের মোট জনসংখ্যার দশ থেকে ১২ ভাগ প্রবীণ হলে সেই দেশকে বার্ধক্য জনসংখ্যার দেশ হিসেবে গণ্য করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের দেশ যাচ্ছে সেদিকেই। কিন্তু এখানে প্রবীণরা প্রতিনিয়ত নানামুখি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রবীণদের একটা বড় অংশই জীবনের শেষ সময়টুকু সুখে শান্তিতে নির্বিঘেœ কাটাতে পারছেন না। সত্যি বলতে কি এখন যেন বার্ধক্য মানেই ঘরে-বাইরে অপাংক্তেয়। বিশেষ করে অভাব-অনটন আর রোগে-শোকে কাবু করে রেখেছে প্রবীণদের একটা বড় অংশকে। সেই সঙ্গে আছে নিঃসঙ্গতা। একদিকে দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিরা যেমন-খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তেমনি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারেও প্রবীণরা স্বজনদের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারছেন না। চাকুরি ব্যবসাসহ নানা কারণে তাদের ছেলে সন্তানরা থাকছেন তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া, প্রবীণদের জন্য নিরক্ষরতাও একটা অভিশাপ। সবকিছুর উর্ধ্বে আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের নবীনরাও একদিন প্রবীণ হবে এবং আজকের প্রবীণরাও একদিন নবীন ছিলো। আজকের নবীনরা প্রবীণদের হাত ধরেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবীণদের জ্ঞান-মেধাকে কাজে লাগিয়ে পরিচালিত হচ্ছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। প্রবীণদের অনুপ্রেরণাতেই আমাদের সভ্যতা গড়ে ওঠেছে তিলে তিলে। তাই সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবেই প্রবীণদের সম্মান জানানো উচিত। যেটা হয় উন্নত বিশ্বে। কিন্তু আমাদের দেশে সম্মান নয়, বরং অনেক সময় অবহেলার পাত্র হিসেবেই প্রবীণরা বিবেচিত হচ্ছেন। যে পিতা-মাতা সারাজীবন অকèান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তুলেন সন্তানদের, তারাই এক সময় সেই সন্তানদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘বোঝা’ স্বরূপ। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একা গ্রামের বাড়িতে রেখে তারা ব্যবসা বা চাকুরির জন্য চলে যাচ্ছে শহরে কিংবা প্রবাসে। অনেক অভিজাত পরিবারের বৃদ্ধ মা বাবার ঠিকানা হয়ে ওঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এমন নজিরও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয় যে, অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিকদের পিতামাতা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।
বার্ধক্যে উপনীত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এদের স্বস্থিদায়ক জীবনযাপনের জন্য চাই যথাযথ ব্যবস্থা। আবহমান বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় মা, বাবা, দাদা, দাদী, ভাই, বোনসহ একান্নবর্তী পরিবারে বসবাসের একটা রেওয়াজ রয়েছে। আর এই ধরনের পরিবারে একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা একটা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে মনে করা হয়। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুরা অসুখ বিসুখসহ নানা অসুবিধায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সেবা ও সহযোগিতা পেয়ে থাকে। কিন্তু ইদানীং ভেঙে গেছে সেই একান্নবর্তী পরিবার। ভেঙে গেছে পারিবারিক বন্ধন। এই প্রেক্ষাপটে অসহায়-দরিদ্র প্রবীণদের বাসস্থান, চিকিৎসা কিংবা খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে, সরকার প্রবীণদের জন্য চালু করেছে বয়স্ক ভাতা। এর পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি সুবিধাভোগিদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। গ্রামীণ এলাকার প্রবীণদের জন্য প্রবীণ ক্লাব করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা (২০১৩) অনুযায়ি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করে তাদের কার্ড প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের এই সব উদ্যোগের পাশাপাশি সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে প্রবীণদের কল্যাণে।