বিদেশ যাত্রায় হন্যে তরুণরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ৪:৪১:৫৪ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
চায়ের দোকানে, চলার পথে, বাসে, ট্রেনে-তরুণদের মুখে সাম্প্রতিক সময়ে খুব বেশি চাউর হচ্ছে-কেবলই দেশ ছাড়ার গল্প। সবার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা, যেন বিদেশ গেলেই বাঁচি। ঘরে-বাইরে যেখানেই তরুণদের জটলা, সেখানেই সেই গল্প গুরুত্ব পায়। গল্পের থিম হচ্ছে-লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ।
বিদেশের ভিসা প্রসেসিং নিয়ে কাজ করেন, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যাচ্ছে। করোনা মহামারির পর থেকে কমবেশী আমাদের সবার চোখে পড়লেও গত দুই-তিস মাস থেকে খুব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে বিষয়টি। তরুণরা যেখানেই আড্ডা দিচ্ছে, সেখানেই উঠে আসছে বিদেশের কথা।
কে আইইএলটিএস দিয়েছে, ফুল স্কলারশিপ পেতে কত স্কোর লাগবে, কোন আইইএলটিএস সেন্টার ভালো হবে-বিদেশ যাবার জন্য এ সকল পরিকল্পনা নিয়ে সময় পার করছে তারা।
অবশ্য বিষয়টাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তাদের মতে, এতে, দেশের লাভ হবে, দেশের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে। তবে সেটি যেন হয়, বৈধ পন্থায়। আবার অনেকে মনে করছেন, যে সকল মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, তারা ফিরে আসবে তো?
কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য, আবার কেউ কেউ উন্নত কর্মজীবনের স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। সেই তালিকায় মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত এমনকি অতিসাধারণ ঘরের সন্তানরাও রয়েছে। তারাও চেষ্টা করছে সুযোগটা কাজে লাগানোর।
নগরীর মির্জাজাঙ্গালস্থ হোটেল নির্ভানা ইনে লন্ডন, কানাডা, ইটালি ও থাইল্যান্ডের ভিসা আবেদন গ্রহণ করা হয়। গত কয়েকমাস থেকে এই হোটেল এবং আশপাশ এলাকার চিত্র যে কারো নজর কাড়ছে। ভোর থেকে বিকেল অবধি নির্ভানা ইনে থাকে ভিসা আবেদনকারীদের দীর্ঘ লাইন। হিসেবে করলে, সেই সারিতে তরুণ-তরুণীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
জিন্দাবাজারে একটি ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের কর্ণধার জুয়েল। তিনি বলেন, আমরা ১৬ বছর ধরে এই কাজ করছি। গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে তরুণরা বিদেশে যাবার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে, আগে কখনো এমনটি দেখিনি। নিজের কাছেও বিষয়টি স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
সিলেটে শিক্ষার্থীসহ তরুণদের মধ্যে বিদেশ যাবার প্রবণতা অনেক পুরনো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে যে ¯্রােত তৈরি হয়েছে, অতীতে এমনটা হয়নি। অবশ্য অতীতে পৃথিবীতে বর্তমানের মতো এমন পরিবেশও ছিলো না। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলো হঠাৎ করে সুযোগের দরজা অতীতের চেয়ে সহজ করে দেয়াটাও তরুণদের মধ্যে বিভিন্ন দেশে যাবার একটা বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
হোটেল নির্ভানা ইন ছাড়াও ভিসা প্রসেসিং সেন্টারগুলোতে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা এখন নিয়মিত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তরুণরা এসকল সেন্টারে কাগজপত্র নিয়ে ঘুরছেন, হিসেব নিকেশ করছেন। সেই হিসেব মেলাতে গিয়ে অনেকে বহু ত্যাগ স্বীকারও করছেন। তবু দিন শেষে যেন স্বপ্নের দেশে যাওয়া হাতছাড়া না হয়।
যারা স্টুডেন্ট ভিসায় যাচ্ছেন তারাও রয়েছেন সেই সারিতে। বিভিন্ন আইইএলটিএস সেন্টারমুখী হচ্ছেন একদল শিক্ষার্থী। তারা নিজেদের স্কিল আরো উন্নত করার পেছনেও সময় ব্যয় করছেন। তাই সেই সেন্টারগুলোর শিক্ষকরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন।
আল-হামরাস্থ একটি প্রতিষ্ঠানের আইইএলটিএস’র শিক্ষার্থী শুভ্র পাল জানান, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাবার চেষ্টা করছি। বিদেশের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
আম্বরখানা এলাকায় একইভাবে একটি বেসরকারি সেন্টারে আইইএলটিএস করতে ভর্তি হয়েছেন আরিফ দেওয়ান। তিনি বলেন, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছি। সরকারি চাকরির জন্যে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সাধারণ প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করার পরও চাকরি হচ্ছে না। তাই বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তবে স্টুডেন্ট ভিসার চেয়ে ওয়ার্কপারমিট মাধ্যমকে বেছে নেয়ার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। একইভাবে কেয়ার ভিসার আবেদনও চলছে সমানতালে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে মানিকপীর সড়কের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমির মো. জিয়াউর রহমান টিটু বলেন, বিদেশ যাবার জন্য তরুণদের মধ্যে প্রবল একটা জোয়ার যেন তৈরি হয়েছে, সেটা আমরাও লক্ষ্য করছি। তবে স্টুডেন্ট ভিসার চেয়ে সেই ¯্রােতে বাড়তি যোগ হয়েছে ওয়ার্ক পারমিট এবং কেয়ার ভিসা। উন্নত দেশগুলো সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ায় এই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।
কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের লেকচারার সিপার উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘যে বা যারাই যাচ্ছে, তারা যদি নিজেদের যোগ্য হিসেবে তৈরি করে বৈধভাবে যায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য, নিজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।’
এ বিষয়ে লামাবাজার এলাকার একজন অভিভাবক জানান, ‘গত একমাসে আমার ছেলের সাথের চারজন বিদেশ চলে গেছে। এখন আমার ছেলেও অস্থির। কিন্তু আমার সেই সামর্থ্য নেই।’
সিলেট চেম্বারের সাবেক সভাপতি এটিএম সুয়েব জানান, ‘সিলেটের প্রেক্ষাপটে তাদের যাওয়া খারাপ দেখছি না। কারণ শিক্ষাজীবন শেষ করে এখানে চাকুরি করার মতো বৃহৎ পরিসরে কোনো শিল্প কারখানা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠেনি। আবার কষ্টের কথা হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষার জন্য যারা যাচ্ছে, তারা কি আদৌ দেশে ফিরে আসবে?’
এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, ‘যারা যোগ্য এবং শিক্ষিত তারা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে গেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে। আর যারা অযোগ্য, তারা বিদেশে গেলে নিজের পাশাপাশি পরিবারের জন্যে দুঃশ্চিন্তার কারণ হবে। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে নিজের দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করবে। তাই যারা যাচ্ছে, তাদের পরিবারকে সেই বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া জরুরি।’