চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও শিক্ষাব্যবস্থা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ২:২৭:৩২ অপরাহ্ন
মো. লুৎফুর রহমান
বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের দরজায়ও কড়া নাড়ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স ও অটোমেশন, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বিগ ডাটা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, ন্যানো টেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিং, ব্লকচেইন, স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের ক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তির যুগান্তকারী ব্যবহার হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যাপক পরিসরে উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। যেমন আধুনিক কলকারখানার প্রায় প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরেনের নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। সেই সঙ্গে রোবট বা রোবটিক্সনির্ভর উৎপাদন ও পরিবহন ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করবে সামগ্রিক সক্ষমতাকে। কলকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ততা (তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে) রয়েছে অন্যান্য পেশাজীবী ও প্রযুক্তিবিদদের; সেই প্রেক্ষাপটে প্রকৌশলবিদ্যার কারিক্যুলামের পাশাপাশি অন্যান্য ফ্যাকাল্টিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি যুক্ত করা এখন আবশ্যক।
বিগত কয়েক দশকে ডিজিটালাইজেশনের জোয়ারে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠ্যক্রম বা কারিক্যুলাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে বিবেচনা করা হয়েছে, একই সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কোর্স ও ওয়ার্কশপ দেখা যায়, যেগুলো তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। বর্তমানে দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা চলছে। কিন্তু এখনও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে, অত্যাধুনিক বিষয়াদি এখনও অনেকটাই অবহেলিত। কম্পিউটার বিজ্ঞান বা এই জাতীয় বিভাগগুলোতে বিগ ডাটা বা মেশিন লার্নিং সংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনা করা হলেও, অন্য বিভাগগুলো এখনও অফিস অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষকদের যুক্ত করতে হবে। বিগত কোভিডকালে শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাসে কিছুটা অভ্যস্ত হলেও শহরাঞ্চলের বাইরে এখনও ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের ফিচারগুলো নিয়ে শিক্ষকদের অভ্যস্ততা অনেক কম। এছাড়াও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে শিক্ষকদের ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচনা করা হয় না। এই অবস্থায় যদি শিক্ষকদের ধারণা আর চিন্তাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন করে বিশেষ কোনও সুবিধা হবে না। সামগ্রিকভাবে বললে, আমাদের প্রত্যেককেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে হবে। মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের যেমন জানা প্রয়োজন কীভাবে সিমুলেশন বা ডাটা সায়েন্স চিকিৎসা গবেষণায় ভূমিকা রাখছে; তেমনি ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পূরণ করছে ক্রেতার চাহিদা; আর শিক্ষকদের জানতে হবে তিনি কীভাবে যুক্ত হয়েছেন এই বিপ্লবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জোয়ারে পরিবর্তন এসেছে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, যোগাযোগ, এমনকি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও। তীব্র জোয়ারের ¯্রােত যেমন নদীর কূল ভাঙে, আবার সেই স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করাও সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিকল্পনার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে লাভবান হবার জন্য বাংলাদেশ এখনও কম-বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এই সুবিধা ও সুযোগকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য শুধু প্রযুক্তি শিক্ষার পাঠ্যক্রম উন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে।
শিক্ষার্থীকে সফল মানবসম্পদে পরিণত করতে জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানগত দক্ষতার প্রয়োজন আবার মূল্যবোধ চর্চার জন্য মনোসামাজিক আবেগীয় দক্ষতার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ব্যবহারিক ও আবেগীয় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জ্ঞানার্জন এবং মূল্যবোধের চর্চা খুবই জরুরি। অতএব এসব দক্ষতার বিষয়ে শিক্ষকবৃন্দকে সর্বদাই নিরলস ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল হলেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তন, সমস্যা সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতামূলক, যোগাযোগ, জীবিকায়ন এবং ডিজিটাল লিটারেসির মতো দক্ষতা অর্জন সহজ হবে। শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিক। তবে উল্লিখিত সব দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতৃত্বগুণসম্পন্ন, পেশাদার, দায়িত্বশীল ও নিবেদিত শিক্ষক দরকার। কেননা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার অগ্রে থাকেন শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষককেই আধুনিক, যুগোপযোগী শিখন-শেখানো পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্বজ্ঞান ও সততার সঙ্গে অর্পিত কার্যাবলী তৃপ্তির সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারার পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ শিক্ষক যেন সামাজিক দুর্বলতার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করা দরকার।
শিক্ষার মান উন্নত করতে প্রয়োজন মেধাবী শিক্ষক, মানসম্পন্ন বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ, গ্রন্থাগার, শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম যেমন খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নিতে আমাদের শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষার (কম্পিউটার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা) পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশের মৌলিক চারটি ভিত্তি হবে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। বিগত কয়েক বছর ধরেই ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ নিয়ে বেশ ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশে। এখন প্রশ্ন হলো দেশটি কি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বাধিক সুবিধা নিতে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত অথবা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে রাষ্ট্র-উন্নয়নে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক: সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।