আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ২:২৬:১৫ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
গ্রিক চলচ্চিত্রকার কনস্টানটিন পিলাভিয়োন ‘হোয়াট ইস দ্যাট’ নামে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেখানে দেখা যায় একজন বৃদ্ধ বাবা বাড়ির পার্শ্বে পার্কের বেঞ্চে বসে আছেন। পাশে তার যুবক ছেলে পত্রিকা পড়ছে। এমন সময় একটি পাখি উড়ে এসে গাছের ডালে বসতেই বাবা জিজ্ঞাসা করেন, ওটা কী বসল? ছেলে উত্তর দেয় চড়–ই পাখি। বাবা একটু পর পাখির নড়াচড়া শুনে আবার জিজ্ঞাসা করেন, ওটা কী? ছেলে উত্তর দেয় চড়–ই পাখি। এভাবে দু’বার একই প্রশ্নের উত্তর দেয় ছেলেটি। তৃতীয়বার পাখির নড়াচড়া শুনে বাবা আবার জিজ্ঞাসা করেন ওটা কী? ছেলে তখন বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে জবাব দেয় ওটা চ-ড়ু-ই পাখি। আর; বাবাকে রাগ করে বলে কতবার বলছি যে ওটা চড়–ই পাখি। চড়–ই পাখি। তুমি কেন বুঝ না। বৃদ্ধ বাবা কিছু না বলে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে উঠে ঘরে চলে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন তার পুরোনো ডায়েরি বই নিয়ে। সেখান থেকে তিনি ছেলেকে পাঠ করতে দেন পুরোনো দিনের লেখা ডায়েরি। আমার ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর, ওকে নিয়ে পার্কে এসেছি। একটা চড়–ই পাখি দেখে সে বার বার জিজ্ঞাসা করেছে ওটা কী? এভাবে সে আমাকে ২১ বার জিজ্ঞাসা করে। আমি ২১ বার তাঁকে বললাম ওটা চড়–ই পাখি। প্রতিবার আমার নিষ্পাপ শিশুর প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় পরম মমতায় আমি তাঁকে বুকে জড়িয়ে চুমা দিতাম। আর বলতাম ওটা চড়–ই পাখি- চড়–ই পাখি। আমি একটিবারও বিরক্তিবোধ করিনি।
যাদের জন্যে এই পৃথিবীতে আসা, যার হাত ধরে পৃথিবীর বুকে হাঁটতে শেখা, যাদের দেখানো পথে পথ চলা, যার পরিশ্রমের ঘামের দামে নিজের বেড়ে ওঠা, তাদের জন্য কি আমরা কিছুটা সময় দিতে পারি না? তাঁদের সঙ্গে কি বিনয়ের সুরে কথা বলতে পারি না? একজন বৃদ্ধ মানুষকে মান্য করা, তাকে একটুখানি মূল্য দেয়া, তাঁর অসুবিধাগুলোতে সাহায্য করা, তাঁকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা এসবইত মানবিকতা। একসময় পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানবোধ প্রদর্শন ছিল আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু ভিন দেশের কালচার অনুপ্রবেশের ফলে পরিবারের সম্পর্কগুলোর মধ্যে আবেগের শক্তির বাধন কেমন যেন ভেঙ্গে পড়ছে। আজকের দিনের এই চিত্রটি একজন বয়স্ক মানুষকে পীড়া দেয়। প্রবীণরা বিপদাসঙ্কুল অবস্থায় অনিশ্চয়তার দোলাচলে তাদের জীবন পার করছেন। একটা সময় ছিল একজন বয়স্ক মানুষ ঘরে থাকলে মনে করা হতো পরিবারটি একটি বৃদ্ধের সুশীতল ছায়ার নিচে রয়েছে।
বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রবীণরা হারাচ্ছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি; বাড়ছে অবহেলা আর শিকার হচ্ছেন বঞ্চনার। সামাজিক মূল্যবোধের অবসরের ধারায় দেখা যাচ্ছে প্রবীণরা প্রথমত: নিজ পরিবারেই নিগৃহীত ও সম্মান হারাচ্ছেন। বিশেষভাবে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা। আর অন্যদিকে চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে থাকার কারণে তারাই পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পতিত হচ্ছেন যাহা জাতীয় সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বে আজকের দিনে বহুবিধ সমস্যার মধ্যে নতুন সমস্যা হলো বার্ধক্য। মানুষের আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশেও বার্ধক্য একটি গুরুতর সমস্যা। প্রবীণরা বিপদাপন্ন। দারিদ্র্যের শিকার ও একাকিত্বে জর্জরিত। জীবনের ক্রান্তিকালে নারী-পুরুষ একাকার হয়ে যান। উভয়ই সমানভাবে পরিবারের অনেক সন্তানের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা করতে হলে তাদের সমাজের-পরিবারের বোঝা না ভেবে তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে দেখতে হবে। প্রবীণদের সুরক্ষা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রবীণদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে হবে। কাজেই প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব নবীণ ও তরুণ প্রজন্মকে নিতে হবে।
পরিশেষে লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথায় বলতে হয়- যৌবন! যৌবন বড় ক্ষণস্থায়ী। বিজলীর ঝিলিকের মতো, মেঘলা দিনের রোদ্দুরের মতো, বার্ধক্য সেই তুলনায় দীর্ঘতর।
লেখক: কলামিস্ট