বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১:২০:৫০ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি’ এমন শিরোনাম পত্র পত্রিকায় হরহামেশাই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আর কটূক্তিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনসভায়ই করা হয়ে থাকে। সেই কটূক্তিগুলো আবার আজকাল ফেসবুকে প্রচার করা হয়ে থাকে। আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ জনসভায় উপস্থিত হয়ে তা শুনেন, কেউ বা ফেসবুকের মাধ্যমে কটূক্তিগুলো দেখে সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে থাকেন। আর অন্য কেউ যদি সত্য ইতিহাস শুনাতে যান তখন এই নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সে ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে সমগ্র জাতি। জাতির জন্য সেটা অবশ্যই এক অশনিসংকেত।
এই অশনিসংকেতটি কিন্তু এককভাবে কোন দল গোষ্ঠী ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য নয়। এর জন্য ভুগতে হবে সবাইকেই। আমাদের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন রয়েছে ভারতে মহাত্মা মোহান দাস করম চাদ গান্ধী, পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইত্যাদি। এই বাংলাদেশেরই অনেক ব্যক্তি গোষ্ঠী দল শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু তো বলেনইনি, জাতির জনক হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারণ করেন না। হতে পারে সেটা তার বা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কিন্তু এটাওতো ঠিক যে, কোন একজনকে তো ‘জাতির পিতা’ হিসেবে মানতে হবে। তাদের মতে কে সেই ব্যক্তিটি হবেন তা তো বলতে হবে। আর শুধু বললেই তো হবে না, সমগ্র জাতিকে তো তা মানতে হবে।
এই জানা আর মানার জন্য তো আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের অতীতকে জানা একান্ত জরুরি। যে কোন দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ বহুলাংশেই অতীতের ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে জন ল্যাক হন নামক একজন মনীষী বলেছেন- ‘ভবিষ্যৎকে জানার জন্যই আমাদের অতীত জানা উচিত।’ বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে তো এ বিষয়ে কোন প্রকার ব্যতিক্রম থাকার কথা নয়। আর জাতি থাকলেই তো কোন দেশের ‘জাতির পিতা’ এর প্রশ্ন আসে। আর জাতি থাকলেই জাতির উন্নতির বিষয়টি সামনে আসে। এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, দেশের অধিবাসী লইয়াই তো দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিই তো জাতি। আর সে দেশকে, সে জাতিকে যদি দেশের জাতির সকলে বুঝিতে না পারে, তবে তাহার উন্নতির আশা করা আর আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের চেষ্টা করা একই কথা। বাংলাদেশ, এর বাঙালি জাতি, এই জাতির জন্মদাতার ইতিহাস জানতে গেলে নিকট অতীতের দিকে মনোযোগ সহকারে নজর দিতে হবে। এবং সেটা গভীরভাবে আর ইতিহাস বিকৃতি থেকে বিরত থাকতে হবে। এভাবে অর্ন্তদৃষ্টির মাধ্যমেই ভাবতে হবে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, সবকিছু জানার পরও ব্যক্তি গোষ্ঠীর স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে সত্যকে মাটি চাপা দেবার নিমিত্তে গোয়েবেলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে সত্য বলে জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা কিন্তু জ্ঞান পাপীর কুকর্ম। এ কুকর্ম থেকে বিরত থাকতে পারলেই জাতি আর জাতির পিতার পরিচয় পেতে কোন কষ্ট হতে পারে না। সত্যিকার পিতৃপরিচয় মিলবে। এটাও মনে অবশ্যই রাখতে হবে যে, কোন সন্তান যদি পিতাকে পিতা বলে স্বীকার করতে অনীহা প্রকাশ করে বসে তাতে ক্ষতি কিন্তু সন্তানেরই, পিতার কিছুই আসে-যায় না। পিতা পিতাই থাকেন। অকৃতজ্ঞতার তকমা সন্তানকেই যুগ যুগ ধরে ধারণ করে চলতে হয়। অর্থাৎ সব কথার শেষ কথা হলো- পিতাকে অস্বীকার করে সন্তান খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। চলার পথে হুছট খাবেই খাবে। সেটা সামাজিক পথেই হোক আর রাজনৈতিক পথেই হউক।
ইতিহাসের একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখতে পাই ভারত বিভক্তির পূর্বে পূর্ববঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ বাঙালির বসতি ছিলো। ভারত বিভাগ হলো। পূর্ববঙ্গ হলো পূর্বপাকিস্তান। আমাদের আগে জাতীয় পরিচয় ছিলো ভারতীয় আর পাকিস্তানে আমরা হলাম পাকিস্তানি। বিলুপ্তির পথে ধাবিত হতে লাগলো বাঙালিত্ব। কৌশলে বা অনেকটা জোরজবরদস্তি করে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার স্থলে উর্দু চাপিয়ে দেবার সবরকমের ফন্দি ফিকির করতে লাগলো পাকি শাসকগোষ্ঠী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন- ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ বাংলার ছাত্র সমাজ রুখে দাঁড়ালো। পাকি পুলিশ গুলি চালালো নিরীহ ছাত্রদের ওপর। নিহত হলেন রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। এই বাংলার বুকে জন্ম নিলো ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজনতার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালিদের জাগিয়ে তোলার শপথ নিলেন। বার বার গ্রেফতার হলেন। এক মামলায় মুক্তি পেয়েও জেলগেইট থেকেই আরেক মামলায় বন্দী হলেন। বার বার জেলখানাই হলো তাঁর ঠিকানা। এমনি চলতে চলতে এলো ১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা জাতির সামনে তুলে ধরলেন। তৎকালীন সময়ে অনেক আ’লীগ নেতাও ৬ দফাকে সমর্থন করলেন না। কেউ কেউ ভয়ে। কেউ কেউ অন্য কোন কারণে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অটল তাঁর সিদ্ধান্তে। ৬ দফা উপস্থাপন করলেন জাতির সামনে। শুরু হলো আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে সমর্থন করলো তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে পাক প্রেসিডেন্ট আয়ূব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করলো। মামলা চলতে লাগলো। ফুঁসে উঠলো বাংলার মানুষ। তৎকালীন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সহ সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সারাদেশ জুড়ে ১১ দফার আন্দোলন। শহর-বন্দর-হাটে-ঘাটে-মাঠে স্লোগান ‘চোখের মণি মণি সিং, বঙ্গ শার্দুল শেখ মুজিব’ জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো। ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
ঊনসত্তরের সেই গণআন্দোলনের রূপ সেদিন যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারাই বলতে পারবেন এর সত্যিকার চিত্র। এর গভীরতা। তখন এমন কোন বাঙালি ছিলেন না যে ঐ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি। তৎকালীন ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নাকি একবার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু আপনার ৬ দফা আসলে কি?’ তখন বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁর স্বভাবসুলভ কায়দায় বলেছিলেন- ‘আরে মিয়া সেটা বোঝনি? ৬ দফা আসলে তো একদফা, বাংলার স্বাধীনতা।’
সেই উত্তাল গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী আয়ূব খান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এলো সত্তরের নির্বাচন। এর ফলাফল কারো অজানা নয়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন বঙ্গবন্ধু অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দল আ’লীগ। কুচক্রী ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো না। এলো বঙ্গবন্ধুর কালোজয়ী সাতই মার্চের ভাষণ। তিনি রাজনীতির কৌশলী ভাষায় বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। বললেন- ‘ভায়েরা আমার….. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ পাক সরকার এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করলো। সারাবিশ্ববাসী স্বীকার করে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, তাঁর স্বাধীনতার ডাকে বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
যেসব বিদেশী পরাশক্তি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চরম বিরোধী ছিলো তারাও এককভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের একমাত্র নেতা বলে স্বীকার করে নিলেন। বাংলাদেশের অন্য কোন নেতার নাম তখন উচ্চারিত হয়নি। না সামরিক না বেসামরিক কোন নেতাই তখন শেখ মুজিবের সমকক্ষ বলে তখন বিশ্বের কোথাও স্বীকৃত হয়নি। পাকিস্তানের কোন সামরিক-বেসামরিক নেতৃবৃন্দ অন্য কোন নেতাকে অভিযুক্ত করেনি। তাহলে ব্যাপারটা আসলে দাঁড়ালো কি? সবই বঙ্গবন্ধুর অবদান? অবশ্যই না। সব নেতাকর্মীর আত্মত্যাগও কিছুতেই অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, মূল চালিকাশক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অতএব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই যে বাংলাদেশের জাতির জনক সেটা অস্বীকার করা মানেই বাংলাদেশের মূল চেতনাকে অস্বীকার করা। প্রকারান্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া। তাতো কখনো কাম্য হতে পারে না।
‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি’ এমনি এক পত্রিকার শিরোনাম নিয়ে শুরু করেছিলাম। এ নিয়ে শেষ করতে চাই। আর এক্ষেত্রে শেষ কথাটি হলো, কোন পরিবার নিয়েই যদি চিন্তা করি আর সে পরিবারের কোন সন্তান যদি তার পিতাকে অস্বীকার করে বসে তাহলে পিতার তো কিছুই যায় আসে না। সন্তানের গুণগত মানেরই বহি:প্রকাশ ঘটে মাত্র। তবে এতে পরিবারটির ঐক্যে ফাটল ধরে। শক্তির অপচয় ঘটে। এই পারিবারিক বিষয়টি যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিবেচনা করা হয় সেটা কী খুব একটা বেমানান হবে? হবে না। তখন সেটা বিভেদ সৃষ্টির নিয়ামক হিসেবেই কাজ করবে। জাতির জনককে নিয়ে কটূক্তি যদি ব্যক্তিগতভাবে করা হয় তখন ব্যক্তির দৈন্যতা, দলীয়ভাবে তা করা হলে তা হবে দলীয় দৈন্যতা, সামাজিক হলে সামাজিক দৈন্যতা বলেই বিবেচিত হয়ে যাবে। যা কখনো কাম্য হতে পারে না। এতে দেশের জন্যও অশুভ বার্তা নিয়ে আসবে। এই জাতির স্বার্থে দেশের স্বার্থে সর্বপ্রকার সংকীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে চিন্তা-চেতনা, মননে-মানসে উদারতায় ঋদ্ধ হওয়ার বিকল্প কোন পথ নাই।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা