সামাজিক সংকট ও প্রতিবাদী স্বর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১:৫০:৪৪ অপরাহ্ন

রোমেনা আফরোজ
বাঙালি জনসমাজকে মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম দুই ধাপে রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিপতিদের অবস্থান। এই দুই শ্রেণি মিলে শুধু দেশকার্য পরিচালনাই করেন না, বরং একে-অপরের স্বার্থ রক্ষার্থে কাজও করে থাকেন। তবে একমাত্র রাজনীতিবিদরা প্রশাসনিক কারণে বিভিন্ন ইস্যু দিয়ে আপামর জনগণকে মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন। এ কথা শুনে পুঁজিপতিদের ক্ষমতা নিয়ে যাদের প্রশ্ন জাগছে তাদের জানিয়ে রাখি, মূলত পুঁজিপতিদের সেবা দেয়ার জন্যই রাজনীতিবিদ এবং দেশের সাধারণ জনগণ নিবেদিত। প্রথমপক্ষ বুঝেশুনে কাজ করলেও দ্বিতীয় পক্ষ নিরুপায়। পুঁজিপতিরা হলেন ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণিবিন্যাস পিরামিডের একেবারে উপরতলার মানুষ। তারা নিজেদের নিরাপত্তাব্যবস্থা অক্ষুণœ রাখার জন্য সবসময় অন্তরালে অবস্থান করেন।
প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, যারা একইসাথে বুদ্ধিজীবী এবং স্যেকুলার, তারা নিজেদেরকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য খুব হিসেবনিকেশ করে বুদ্ধি খরচ করেন। যেহেতু তারাই সংস্কৃতি এবং শিক্ষাদীক্ষাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন, তাই তারা পেতে চান সাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার। কিন্তু চতুর্থ দলভুক্ত শিক্ষিত মানুষ যারা অতি সম্প্রতি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছেন, তাদের ডিএনএ-র মধ্যে রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক ক্ষোভের একবিন্দু আগুন।পাকিস্তানি শোষণ-শাসনের যন্ত্রণাকেও বাদ দেয়া চলবে না, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর যে স্বপ্নের দেশ তৈরি হবার কথা ছিল তার বিপরীতে এক সাগর প্রতারণার বিদ্বেষ এখনো তাদের বুকে জ্বলছে। মাঝেমধ্যে ধর্ম নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অসহিষ্ণুতা তাদের মনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এইসব আগুনের সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পুঁজিপতিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। সব মিলিয়ে তারা এখন বিদ্রোহী। ঘৃণার আগুন কোথাও ঢেলে দিতে পারলে তারা বেঁচে যায়। তাই তথাকথিত প্রগতিশীলরা যখন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের ধ্যান-ধারণা, মতবাদকে চাপিয়ে দিতে চান তখন সাধারণ মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ান।
পঞ্চম দলের সর্বহারা মানুষ তাদের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কৃষিখাতকে সমুন্নত রেখেছেন। এদের একমাত্র স্বপ্ন দু’মুঠো ভাত। প্রকৃত অর্থে এরাই প্রাকৃতজন। কারণ এরা মাটির কাছাকাছি বসবাস করেন। বিবর্তনের জন্য মন-মস্তিষ্ক এবং রক্তে যেসব উপাদানকে মিশতে হয় সেসবের আনুকূল্য এরা পাননি। এরা প্রতিবাদ বোঝেন না। প্রতিবাদহীনতার যে-পরিণাম তা সম্পর্কেও এরা অসচেতন।
উল্লিখিত শ্রেণিবিন্যাসের কারণে আমাদের দেশে যেকোনো প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তৃতীয় এবং চতুর্থ দলের মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের মূল কারণ ধর্ম। যেহেতু তৃতীয়দল শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগামী, কলকাতাভিত্তিক বুদ্ধিজীবীদের অনুকরণে তারা ধর্মবিরোধীও, ফলে এদের মধ্যে অহংবোধ আছে যে, তারা সাহেবদের বংশধর কিংবা সাহেবদের থেকে কম নন। এরই ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে একপ্রকার সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। তারা তাদের বুদ্ধিমত্তাকে সর্বস্তরের মানুষের জন্য ব্যবহার না করে কাজে লাগান নব্যশিক্ষিত মানুষদের উপর কলোনিয়াল মনোভাব চাপিয়ে দিতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে, প্রতিবাদ না করলে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। মূলত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা পাল্টা প্রতিবাদ করে রণক্ষেত্রে সবসময় সরব থাকেন। সামগ্রিকভাবে এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই স্বাভাবিক এবং সুন্দর। কিন্তু প্রতিবাদ যদি গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে তা দেশের জন্য বিপদজনক। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বিদ্যমানতার বিপক্ষে আওয়াজ তোলা সম্ভব হয় না। এতে মৌলিক বিষয় যেমন খাদ্য, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে ঐক্যবদ্ধ হবার সম্ভবনা নষ্ট হয়। তাই সামগ্রিক স্বার্থে গোষ্ঠীচেতনা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। নিজস্ব ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে সমাজের আবাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়।
ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ থাকলে সামগ্রিকভাবে মানুষ নিজ ক্ষুদ্রতা টের পায় না। তাই প্রগতিশীলদের মধ্যে যে কলোনিয়াল মানসিকতা মানবিকতার পথকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে তা অজ্ঞাত রয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। কারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি থেকে সাধারণ মানুষের জন্য যে-দিকনির্দেশনা তৈরি হবার কথা তা সামগ্রিক না হলে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী সংকট চলছে। এই সংকটের গোড়াতে রয়েছে গোষ্ঠীচেতনা। সাধারণ মানুষদের ক্ষমতা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা মূলত নিজেদের মৌলিক অধিকার নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু একটা জায়গায় দু’পক্ষের বেশ মিল আছে, তারা গোষ্ঠীগত ধ্যান-ধারণা, মতবাদের প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রথম সুযোগেই অপরপক্ষের কণ্ঠকে রুদ্ধ করতে বেশ তৎপর। তারা হরণ করতে চান বাক স্বাধীনতা। দু’পক্ষই ভুলে যান, প্রতিবাদ করা মানুষের জন্মগত অধিকার। হয়তো সাধারণ মানুষ স্যেকুলারদের মত কেউকেটা গোছের কেউ নয়, জ্ঞানে-গুণে তাদের কমতিও আছে, কিন্তু সবার দেহে একইরকম লাল রক্ত, সবার ঘাড়ে একখানা করে মাথা আর সেই মাথা দিয়ে তারা রাজ্যের একূল-ওকূল অনেক কিছুই ভাবতে পারেন। ধর্মের পতাকাতলে অবস্থানও নিতে পারেন।
প্রতিবাদ মানে আমরা বেঁচে আছি। প্রতিবাদ মানে আমরা দুর্বল নই। তাই সবার প্রতিবাদ চলতে থাকুক। তবে প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার আছে বলেই সীমা লঙ্খন করা উচিত নয়। সম্প্রতি দলগুলোর মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা বলার যে-অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা এখনি বন্ধ করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সহিষ্ণুতা একদিকে যেমন পারিবারিক ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে, তেমনি ব্যক্তির মুক্তচিন্তাকেও তুলে ধরে। এই পুঁজিবাদী সময়ে আমাদের সহিষ্ণুতার খুব প্রয়োজন। অথচ আমরা সবাই যেন মানবতা, সভ্যতার সমস্ত চিহ্ন ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছি। এখনি অসহিষ্ণুতার অপসংস্কৃতিকে রোধ করা না গেলে সমাজ ভেঙে আরও টুকরো টুকরো হবে। তাতে সর্বহারাদের গলায় শক্ত হয়ে চেপে বসবে পুঁজিবাদী রজ্জু। আমাদের জানতে হবে, কোথায় নীরবতা পালন করলে মানবতা অক্ষুণœ থাকে। এক পক্ষ প্রতিবাদ করলে অপর পক্ষের আলাপ-আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। মুক্তচিন্তার চর্চা মানুষের স্নায়ুর কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। তৈরি হয় সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। তখন বোঝা যাবে রাষ্ট্রের অধিকাংশ ইস্যু তৈরিকৃত, যার মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক এবং শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি অন্তরালে রাখা। এতে রাজন্যবর্গদের তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেয়ার পথটা সহজ হয়। তাই দৃষ্টিকে প্রসারিত করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ গেলে মানুষ পাওয়া যায়,পাওয়া যায় গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ও, তবে দেশ হারালে তা উদ্ধার করার পথটি অত্যন্ত জটিল।
মানুষ যদি সংখ্যালঘু কিংবা কম শিক্ষিত বলে প্রতিবাদ করার অধিকার হারিয়ে ফেলে, তবে রাষ্ট্রও স্বৈরাচারী হবার সুযোগ পেয়ে যাবে। কারণ যেকোনো দেশের প্রতিনিধি মূলত দেশের মানুষের চরিত্রের প্রতিফলন। একদিন হিটলার বর্ণ বিদ্বেষের নামে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন। এই হিটলারীয় মনোভাবকে ব্যক্তি যতই উস্কে দেবে ততই প্রসারিত হবে ফ্যাসিস্ট হবার পথ। বন্ধ হবে মানবতাচর্চা।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর লোক একসাথে বসবাস করে। রয়েছে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়। প্রত্যেকের পারিবারিক শিক্ষা আলাদা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও এক নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ স্বাভাবিক বিষয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, সবার মধ্যে যদি একই বিশ্বাস ঘূর্ণিভূত হতো, তবে জ্ঞানের বিকাশ ঘটতো না। মূলত সমাজে হাজার হাজার বিভাজন খুব কৌশলে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায়। কারণ জাতীয় পর্যায়ে মানুষের ঐক্যবদ্ধ হবার পথ বন্ধ হয়ে গেলে মৌলিক বিষয়গুলোর সমাধানে রাজনীতিবিদদের ভাবতে হয় না। একবার ভাবুন, সেদিন আমরা যদি প্রতিবাদ না করে উর্দুকে মেনে নিতাম কিংবা পাকিস্তানিদের শাসন নীরবে মেনে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতাম, তবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হত না। যেকোনো আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতি দিতে হলে এক পতাকাতলে সমবেত হওয়া অপরিহার্য। তাই প্রতিবাদকে চিৎকার না ভেবে মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়া ভাবতে শিখুন।
বর্তমানে আমাদের পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাও ঔপনিবেশিক। এজন্যে দায়ী পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। এখন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত পুঁজি। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঘুণপোকার মত আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ফেলছে। আমরা দিনদিন চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছি। অন্যের মতবাদকে নিজের ভেবে তুষ্ট হচ্ছি। আমাদের সামগ্রিক ধ্যান-ধারণা, মতবাদ তৈরি হচ্ছে না। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কখনো বোধের সৃষ্টি হবে না। সেক্ষেত্রে কেন গোষ্ঠীচেতনা থেকে বের হতে হবে, কীভাবেই বা এর উত্তরণ সম্ভব, সেই বিষয়গুলো পরিস্ফুট হবে না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে পারিবারিক শিক্ষাকেও জোরদার করতে হবে। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে না দেখে ধর্ম এবং দেশের সূত্র ধরে প্রতিবাদ করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ সংঘটিত হতে থাকবে। প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে আওয়াজ তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের কোনো দেশ কিংবা ধর্ম নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক