জুড়ীতে প্রাণিসম্পদ অফিসের প্রকল্পে ‘নয় ছয়ের’ অভিযোগ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ৪:৪৬:৫৬ অপরাহ্ন
জুড়ী (মৌলভীবাজার) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ঃ মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলায় লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় হাঁস ও মুরগির ঘর নির্মাণ কাজে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের বিরুদ্ধে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনস্থ লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টটি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় জুড়ী উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের কোণাগাঁও গ্রামের ৪০ জন খামারী নিয়ে দল গঠন করা হয়। চলতি বছরে ওই গ্রামের ৪০ জন খামারি মহিলা সদস্যের হাঁস মুরগির ঘর নির্মাণের জন্য ৮০ বাই ৬০ ইঞ্চির টিনের ঘর নির্মাণের বরাদ্দ আসে। প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ হয় ২০ হাজার টাকা করে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, খামারিদের নামে বরাদ্দকৃত ২০ হাজার টাকা চেকের মাধ্যমে তুলে খামারিরা ইচ্ছেমত টাকা যোগ করে ঘর বড় করতে পারবে। কোনক্রমেই এ বরাদ্দের টাকা ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করানোর কোন নিয়ম নেই। কিন্তু জুড়ী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রমা পদ দে ৪০ জন খামারির ২০ হাজার টাকার চেকে স্বাক্ষর নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের হাতে টাকা তুলে দেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০ হাজার টাকা তুলে তার থেকে ৮-১০ হাজার টাকা খরচ করে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর নির্মাণ করার অভিযোগ রয়েছে। যা সম্পূর্ণ এ প্রকল্পের নিয়ম বহির্ভূত। খামারিদের কাছ থেকে চেকে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন, নিম্নমানের কাজ ও মেয়াদ শেষ হলেও অনেকের এখনো ঘর নির্মাণ করে না দেয়ায় প্রকল্প নিয়ে সাধারণ খামারিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ প্রকল্পের পুরো টাকা নিয়ে ‘নয় ছয়’ হওয়ায় প্রকল্পের সার্থকতা মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে খামারিরা অভিযোগ করেন।
কৃষক ও খামারিদের দাবি- ডা. রমা পদসহ অফিসের কর্মকর্তারা তাদেরকে দিয়ে চেকে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন। পরে নিজের পছন্দের লোক দিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।
খামারিদের অভিযোগ, প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তাদের যে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন তাতে খরচ হয়েছে ৮-১০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ৪০ জন খামারিকে চেকে স্বাক্ষর রেখে মোট ৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জামিল আহমেদকে কাজ পাইয়ে দেন। তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রমা পদ দে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি না দেয়ার কথা বললেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জামিল আহমদ কাজটি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো বেশ কয়েকটি ঘরের নির্মাণ শেষ হয়নি। এক থেকে দেড় মাস আগে ঘরের খুঁটি বসালেও এখনো ঘরের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় খামারিরা হতাশায় ভুগছেন। অনেক বাড়িতে দেখা যায় একই পরিবারে দুই থেকে তিনটি ঘর দেয়া হয়েছে। অপরদিকে অনেক খামারে গিয়ে দেখা যায় ঘর আছে কিন্তু হাঁস কিংবা মোরগ নেই।
খামারিরা জানান, যে ঘর আমাদেরকে নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে সেই ঘরে অনায়াসে শিয়াল বিড়াল ঢুকতে পারছে। এ ছাড়া নিম্নমানের কাজ হওয়ায় ঘরের পিলার ভেঙ্গে পড়া সহ দরজা ঠিকমতো বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিশ হাজার টাকা আমাদেরকে দিলে আমরা এর চেয়ে উন্নত ঘর বানিয়ে কিছু টাকা দিয়ে হাঁস-মুরগি কিনতে পারতাম। ঘর নির্মাণে দুর্নীতি নিয়ে কথা বললে অনেকের ঘর ফেরত নিয়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন কর্মকর্তারা এমনটাই জানিয়েছেন খামারিরা।
খামারি রাহেলা বেগম জানান, টাকা তোলার জন্য আমাদেরকে ব্যাংকে নিয়ে টাকা উত্তোলন করে ঘর বানিয়ে দেবার কথা বলে টাকা নিয়ে যান। অথচ কয়েকদিন আগে আমাদেরকে মিটিং করে বলেন আমরা ঘর বানিয়েছি এমন কথা সবাইকে বলার জন্য।
খামারি আনোয়ারা বেগম জানান, ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর আমার হাত থেকে তারা টাকা নিয়ে নেয়। আমরার ঘর বানানো হয় নি।
খামারি মনিরা বেগম জানান, আমরা মোরগের ঘর পেয়েছিলাম। ওই ঘর তৈরির জন্য ২০ হাজার টাকা লাগবে বলে সরকারি অফিসাররা জানান। আমাদেরকে ব্যাংকে নিয়ে টাকা উত্তোলন করে ঘর তৈরি করে দেবেন বলে টাকা নিয়ে যান। টাকার মুখ আমাদের দেখা হয়নি।
এ ছাড়া কোনাগাঁও গ্রামের খামারি পিয়ারা বেগম, আয়শা আক্তার, ফুলবানু বেগম, আঙ্গুরুন বেগম, আখলিমা বেগমসহ বেশ কয়েকজন খামারি জানান, হাঁস-মোরগের ঘর তৈরির জন্য আমাদেরকে সরকার ২০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিল। এই টাকা দিয়ে আমরা নিজেরা যে ঘর বানাতে পারবো এমনটি কেউ বলেনি। বরং অনেকটা ভয় দেখিয়ে ব্যাংক থেকে স্বাক্ষর রেখে টাকা নিয়ে যান স্যাররা। এ বিষয়ে কাউকে কিছু জানালে ঘর ফিরিয়ে নেয়ার হুমকিও দেন।
খামারিদের সভানেত্রী রিনা বেগম জানান, স্যারদের ফোন পেয়ে ব্যাংকে গিয়ে টাকা উত্তোলন করে স্যারদের কাছে দিয়েছি। স্যাররা ঠিকাদার জামিল ভাইয়ের মাধ্যমে কাজ করিয়েছেন। আমরা টাকা নিয়ে ঘর বানাতে পারব এমন কথা কেউ আমাদেরকে বলে নি। জানলে আমরা নিজেই টাকা নিয়ে ঘর বানাতান। ঘর বানাতে এত টাকা লাগত না।
লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের এলএসপি (সমন্বয়কারী) সাইদুল ইসলাম জানান, প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা রমা পদ দে স্যারের নির্দেশনা মতে সবাই ঠিকাদার জামিলকে টাকা দিয়েছে। তিনি ঘর তৈরি করে দিয়েছেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জামিল আহমদ জানান, আমরা কাজ পেয়েছি। কাজ চলমান আছে। সকল খামারিরা আমাদেরকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন।
জুড়ী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. রমা পদ দে জানান, ‘উপজেলায় হাঁস-মুরগির ঘর নির্মাণের জন্য ৪০ জনের নামে ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খামারিরা নিজেরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেরাই ঘর তৈরি করেছে। তবে পছন্দের ঠিকাদার কে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এ কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুস ছামাদ জানান, এ প্রকল্পের আওতায় খামারিদের নগদ বিশ হাজার টাকা দেয়া এবং খামারিরা নিজেই ঘর নির্মাণ করার কথা। ঘর তৈরিতে অনিয়মের কোন অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।