গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ৮:০৫:০৪ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তৈরি করতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো ভোট ও ভাতের অধিকার। তাদের মতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণের মধ্যেই নিহিত আছে গণতন্ত্র। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি’র কাছে এই মুহুর্তে গণতন্ত্র হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোটের আয়োজন। এই আয়োজন নিশ্চিত হলে গণতন্ত্র বৃক্ষ মাটি ফুঁড়ে পত্র-পল্লবে বিকশিত হতে পারবে। বিএনপি’র ভাষ্য অনুযায়ী দলটি যে আন্দোলন করছে সেটি হলো হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। তাদের মতে আওয়ামী শাসনমুক্ত পরিবেশ হলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এরকম প্রতিটি দল এবং জোট তাদের মতো করে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞা প্রদান করে থাকে। সংজ্ঞা গুলোতে সর্বজনীন গণতন্ত্রের মূল বাণী নয়, দলীয় স্বার্থকে যুক্ত করে নিজেদের মতো করে সংজ্ঞা তৈরি করা হয়।
সরলভাবে যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র কাহাকে বলে’, অথবা গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা কী? এ’প্রশ্নের উত্তরে তারা হয়তো এরকম একটি সংজ্ঞা প্রদান করতে পারেন; যে প্রক্রিয়া অনুসরন করলে আমাদের দলটি সহজভাবে ক্ষমতায় আরোহন করতে পারবে কিংবা প্রাপ্ত ক্ষমতাকে সংহত করতে পারবে তাহাকেই বাংলাদেশী গণতন্ত্র বলে। সরলীকরণ করে বলা হলেও লক্ষ্য করুন কোন ভারী কথা নাই। তত্বে ভরপুর দুর্বোধ্য বিষয় এই সংজ্ঞায় স্থান দেয়া না হলেও সংজ্ঞাটি বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্থিত, খাটি বাংলাদেশী গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। সর্বজনীন গণতন্ত্রের সংজ্ঞার ধারণার সাথে সাদৃশ্য না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেনা, এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। বাংলাদেশী জাতের গণতন্ত্রে ক্ষমতাই আসল কথা। তবে এই সংজ্ঞায় একটি পাদটীকা আছে আর সেটি হলো, দল গুলো ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা বহির্ভুত থাকলে সংজ্ঞার ধারণা বিপরীতমুখী হতে পারে। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচল যতোই থাকুক না কেনো এ’বিষয়ে দল গুলোর মধ্যে গোপন এবং অদৃশ্য একটি চুক্তি আছে বলে আমজনতা ধারণা করে থাকে। যেহেতু চুক্তিটি গোপনে করা হয়েছে, এই ক্ষেত্রে দেশে বা বিদেশের কোন সংস্থা বা সরকারের কাছে বাংলাদেশী গণতন্ত্রের মডেল সম্পূর্ণ উন্মোচন করা সম্ভব নয়। এছাড়া স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী বিষয়টি সংবেদনশীল। এ কারণে ধারণাটি যখন তখন যার তার সামনে উন্মোচন করলে ধারণাটির আবেগে আঘাত আসতে পারে। স্থানীয় সংস্কৃতিতে আঘাত করা নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশে ইদানীং অনেক শব্দের সাথেই মডেল শব্দটি জুড়ে দেয়া হচ্ছে। থানাগুলোর অধিকাংশকে মডেল থানা নাম দেয়া হয়েছে। মডেল থানার আওতাধীন এলাকায় যখন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, গুম, লুটতরাজ চলে তখন সংবাদ পত্রে লেখা হয়, ঘটনাটি অমুক মডেল থানার ২০০ গজ সীমানার মধ্যে সংঘটিত হয়েছে।আহারে মডেল! মেডেল থানার দুই-শত গজের মধ্যে যদি এরকম অপকর্ম ঘটে থাকে তাহলে যেগুলো মডেল নয় সেগুলোর অবস্থা কল্পনা করতেও ভয় পেতে হয়। মডেল কথাটিকে এ’ভাবে ব্যবহার করে মডেল শব্দের সতীত্ব হরণ শুধু আমরাই করতে পারি। এক সময় মডেল শব্দটি শুধুমাত্র স্কুলের পূর্বেই বসতো। স্কুলগুলো প্রকৃত অর্থেই মডেল ছিলো। এখন মডেল বলেই আমরা ক্ষান্ত হতে পারিনা, এর সাথে ইংরেজি ভাষা থেকে ‘রোল’ শব্দটি ধার করে মডেলের পূর্বে বসিয়ে দিয়ে বলি ‘রোল মডেল’। আমরা এখন বলি বাংলাদশ হলো উন্নয়নের রোল মডেল। রোল মডেল কথাটির অর্থ হলো এমন একটি আবিস্কার, যা’ দেখে অন্যরা শিখতে পারে। বাংলাদেশী মডেলের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা খুব কম শোনা যায়। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের রোলমডেল এ’কথাটিও তেমন শুনতে পাইনা। গণের তন্ত্র হলো গণতন্ত্র। গণ অর্থাৎ মানুষ, রাষ্ট্রের নাগরিক। গণতন্ত্রে ইদানীং “গণ”কে খুঁজে পাওয়া যায়না। যারা রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন তাদেরকে অন্তত গণতন্ত্রের চেতনা অনুযায়ী গণমানুষ বলা যায়না।
গণতন্ত্রের মূল কথাটি কী? গণতন্ত্রের মূল বাণী হলো জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন তারা নিছক নাগরিকদের পক্ষে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটাবেন। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের মধ্যে পদ্ধতিগত ব্যবধান রয়েছে। তবে জনগণকে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করা হলো যুবরাজ হ্যামলেট চরিত্র ছাড়া মহামতি শ্যাক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের গল্প বলা বা নাটকটি মঞ্চায়ন করা। তবে গণতন্ত্রকে রাজনীতির সংস্কৃতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ কোন কাজ নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনে ব্যবস্থাটিকে পাকাপোক্ত করতে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু শতাব্দী। ১২১৫ সালে ঐতিহাসিক ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষরের মাধ্যমে রাজা জনশাসন ব্যবস্থায় সামন্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকার করে নেন। ম্যাগনাকার্টা প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণের স্বার্থ সুরক্ষিত করেনি। সে সময়ের বিবেচনায় সামন্তরাই ছিলেন জনসাধারণের প্রতিনিধি। তারই ধারাবাহিকতায় গোড়াপত্তন ঘটে লর্ডসসভা ও কমন্সসভার। ১৪০৭ সালে রাজা পঞ্চম হেনরি কমন্সসভা তথা জনসাধারণের প্রতিনিধি পরিষদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন। এভাবেই গণতন্ত্রের সুতিকাগারে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পরিপুষ্ঠ হতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে গণতন্ত্রের কত যে প্রকারভেদ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রও প্রতিনিধিত্বশীল। কিন্তু প্রতিনিধি সভা আইন প্রণয়ন করলেও দেশ পরিচালনায় প্রাধান্য প্রেসিডেন্টের। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ সকল দেশেই গণতন্ত্রে, জনগণ বসে থাকেন পরিচালকের আসনে আধুনিক মানুষ ইংরেজিতে যাকে বলেন ড্রাইভিং সিট।
আমাদের গণতন্ত্র থাকে হাসের বাড়িতে। হাস হলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত।মানুষ একসময় সন্ধ্যা হলে হাঁসকে জলাশয় থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য তই, তই করে ডাকতে থাকতো। এ’নিয়ে একটি অসাধরণ কবিতা আমাদের অনেকের পাঠ্য ছিলো।কবি রওশন ইজদানীর লেখা কবিতাটির কয়েকটি লাইন এখনও মুখস্থ আছে, ‘সন্ধ্যা ঘনায়ে এলো বেলা গেল ঐ/কোথা গেল হাঁস গুলো তই তই তই/।’ তখন মানুষ হাঁসকে ডেকে নিয়ে ঘরে তুলতো এখন হাসের ডাকে আমাদের রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তার বাড়িতে ছুটেন। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাহীন দল গুলো জাতীয় সংকটে কখনো সংলাপে বসার কথা চিন্তাও করেননা এমন কী সম্পর্ক অনেকটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু হাস যদি ডাকেন তখন হাসতে হাসতে ডান, বাম, মধ্য, “ধর্ম” সকলেই উপস্থিত হন সহাস্য বদনে। তাঁর মানে আমাদের রাজনীতি এখন আর কৃষকের আঙিনাতে নেই, শ্রমিকের হাতের মুষ্টি থেকে রাজনীতিকে আমরা বের করে দিয়েছি। যেহেতু রাজনৈতিক দল গুলো সাধারণ মানুষের সমর্থন,অংশগ্রহণ, জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়ে ভাবেনা তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি চলে গেছে দিল্লী, ইসলামাবাদ, ওয়াশিংটন, মস্কোর শক্তিশালী কূটনৈতিক বাড়িতে।
আমাদের গণতন্ত্র যতদিন-না জন-অংশগ্রহণের শক্তিতে বলীয়ান হবে ততদিন আমাদের দেউলিয়াপনাত্ব ঘোছবে বলে মনে হয়না। নির্বাচনই কেবল মাত্র গণতন্ত্র নয় গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সকল মত সকল পথের বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। জনপ্রিয় ভাষায় যাকে বলা হয় শতফুল বিকশিত হওয়া। শতফুলের বিকাশের জন্য প্রয়োজন বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়া, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা, মত প্রকাশের সুযোগকে অগ্রাধিকার দেয়া। এ’জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লালন পালন। রাজনৈতিক দল গুলোর অভ্যন্তরে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে তারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবেন কী করে। পরাশক্তির আনুকুল্য পাওয়ার জন্য লবিং, তদবিরের মাধ্যমে ক্ষমতারোহন করা যায় কিন্তু গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যায়না।যথাযথ গণতন্ত্রের চর্চা না হলে ভূ-গ্রামের অন্যান্য দেশ থেকে সমীহ লাভ করা যায়না। বারগেইনিং বা দরাদরির ক্ষমতা কমে যায়। বিশ্বরাজনীতিতে দেশের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে দৃঢ় করা প্রয়োজন। পিটার হাসের বাসভবনের অভ্যন্তরে নয়, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এই ঐক্যমতের জন্য একসময় এগিয়ে আসতেন প্রখর বিবেক বোধ সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা, তাদেরকে এখন আর দেখা যায়না।সকলেই এখন নানা রঙের জামা গায়ে চড়িয়েছেন। স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের উত্তরসুরীরা এখন খুব তৎপর। মনে রাখতে হবে স্টিফেন নিনিয়ানদের চেষ্টা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলো। “তাল গাছটি আমার” এ’কথাটি বলতে হলে তালগাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমরা কী তালগাছের বিনিময় হলেও নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করবো। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভাবতে হবে গভীর দেশপ্রেম নিয়ে। সাময়িক স্বার্থ লাভের জন্য আমাদের কোন ভুল সিদ্ধান্ত যেনো আত্মঘাতি না হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলো কী সতর্ক সংকেত শুনতে পাচ্ছে?
লেখক : প্রাবন্ধিক।