খতীব আল্লামা উবায়দুল হক (রহ.)
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ৯:০১:৫৩ অপরাহ্ন
মুফতী ফয়জুল হক জালালাবাদী
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, দেশের আলেম সমাজের মুরুব্বী, শিক্ষক-অভিভাবক, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা, ইসলামী অর্থনীতির দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমে দ্বীন, শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা উবায়দুল হক (রহঃ)-এর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনীষীদের আবির্ভাবে পৃথিবীতে যেমন দ্বীন ও ঈমানের রৌশনী বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি তাঁদের তিরোধানও পৃথিবীবাসীকে করে তোলে বেদনাকাতর।
শায়খুল হাদীস মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ) ১৯২৮ সালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বারঠাকুরী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাফেজ মাওলানা জহুরুল হক (রহঃ)। তিনি একজন খ্যাতিমান আলেম এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন।
পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশ ও ইসলামী জোশ ও খরুশের পরশেই মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ)-এর প্রাথমিক শিক্ষার দ্বার উদ্ঘাটিত হয়। পিতার তত্ত্বাবধানে তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার পরিধি ক্রমশই বিস্তৃত হতে বিস্তৃততর হতে থাকে। দরছে নেজামীর কিতাবাদি তিনি সিলেটেই অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন প্রখর ধীশক্তির অধিকারী। প্রতিটি বিষয়ের জটিল সমস্যাদির সুষ্ঠু সমাধান তিনি অনায়াসে দিতে পারতেন।
দেওবন্দের দারুল উলুম মাদরাসার আকর্ষণ ক্রমেই তাঁর হৃদয়ের তারে প্রভঞ্জন সৃষ্টি করে চলেছিল। তাই তিনি উচ্চতর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে ভারতের দেওবন্দ দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। সুযোগ্য আসাতেজায়ে কেরামের তিনি ছিলেন প্রিয় ছাত্র। তার মেধা, সূক্ষ্ম চিন্তা শক্তি ও আকর্ষণীয় চারিত্রিক গুণের জন্য সকলের কাছেই তিনি ছিলেন আদরণীয়। তিনি ১৯৫০ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করে আবার ফিরে যান। তিনি মুফতী শফি উসমানী (রহঃ) প্রতিষ্ঠিত করাচীর মাদরাসায় কিছু দিন অধ্যাপনা করেন। তারপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে এখানকার শীর্ষ পর্যায়ের কওমী মাদরাসার মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানার (শায়খুল হাদীস) পদে বরিত হন। দীর্ঘ ৩১ বছর তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসা হতে অবসরগ্রহণ করেন।
অবসরগ্রহণের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে তিনি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতীব নিযুক্ত হন। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত সুনাম ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন।
খতীব আল্লামা উবায়দুল হক এর অসাধারণ দ্বীনী খেদমত বিশেষত নবী করীম (সাঃ)-এর খাতামুন্নাবিয়্যিন হওয়ার প্রতি অবিশ্বাসী কাদিয়ানী তথা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদৃঢ় প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনা করা এবং জাতীয় মসজিদের খতীবের অবস্থান থেকে খোদাদ্রোহী, নাস্তিক মুরতাদদের প্রতিরোধে সঠিক সময়ে প্রকৃত সত্য সম্বলিত বিষয়াদি দেশের আপামর জনসাধারণের সম্মুখে তুলে ধরা এবং স্পষ্টবাদিতা ও মুসলিম ঐক্যের ব্যাপারে তিনি জোরদার ভূমিকা পালন করেন এবং জুমার নামাযে যুগোপযোগী খুৎবা প্রবর্তন করেন। জাতীয় জীবনের সকল সমস্যায় তিনি সব সময়ই সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করতেন। বাংলাদেশের বহু প্রখ্যাত মাদরাসার মজলিসে শূরার সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর লিখিত বহু বই মাদরাসায় পাঠ্য। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ইসলামী ব্যাংকসমূহের শরীয়া কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ) ছিলেন ক্ষুরধার লেখনী শক্তির অধিকারী। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার অগণিত লেখা প্রকাশিত হয়েছে। একজন মৌলিক ইসলামী চিন্তাবিদ, আদর্শ লেখক হিসেবেও তিনি সর্বত্র খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর অসংখ্য খুৎবা, বক্তৃতা ও লেখনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে (ক) তারিখে ইসলাম (খ) সীরাতে মোস্তফা (গ) তাসহিল কাফিয়া (ঘ) নাসরুল কাওয়ায়ীদ (ঙ) সেকায়া (চ) শিয়া সুন্নী বিরোধ ও (ছ) কুরআন বুঝিবার পথ ইত্যাদি।
হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ)-এর জীবন ছিল সুদীর্ঘ। তিনি ২০০৭ সালের ৬ অক্টোবর শনিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। এই মহান মনীষীর দীর্ঘমেয়াদী জীবনকালের মধ্যে ৩১টি বছর অতিবাহিত হয়েছে মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকা-এর সংস্পর্শে এবং প্রায় ২৩টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতীব হিসেবে। জাতীয় পর্যায়ের এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের সহিত সংযুক্তির ফলে তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছিল নানা বর্ণে, নানা ছন্দে।
একজন মানুষের বহুমুখী প্রতিভার বিকাশের প্রতি যদি গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ)-এর প্রতি সকলেরই দৃষ্টি নিবন্ধ হবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর যাই বলি বাংলাদেশের আলেম সমাজের মণিকোঠায় তাঁর নাম অবশ্যই জাগরুক থাকবে। তার বক্তৃতা বা ভাষণের মাঝে এমন একটি আকর্ষণ ও প্রেরণা ছিল, যা সকলের মনে-মগজে অনায়াসেই স্থান করে নিত। আজ আমাদের মাঝে হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহঃ) নেই, আছে তাঁর কর্মময় জীবনের স্মৃতির ও কীর্তির সমুজ্জ্বল নিদর্শনাবলী, যা অনাগত কালের মানুষকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আলোকোজ্জ্বল পথের দীক্ষা দিতে থাকবে।
লেখক : শিক্ষক, রাজনীতিক