চক্ষুকর্ণ ও অন্তরের আবরণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ৯:০৫:০৬ অপরাহ্ন
হিফজুর রহমান
পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণীর বাস। সেগুলো বিভিন্ন আকার ও আকৃতির। তাদের আকার আকৃতিগত পার্থক্য থাকলেও ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে শুরু করে মানুষসহ বিশালকায় সব প্রাণীরই রয়েছে একটি কংকাল কাঠামো এবং তার উপর একটি মাংসল আবরণ। এই অস্থি-মজ্জা এবং মাংসের কাঠামো। কিন্তু তাকে প্রাণী বানায় না; তার প্রাণী হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় চেতনের। আর এজন্যই তার সাথে রয়েছে সারা শরীরব্যাপী বিভিন্ন ইন্দ্রিয়। এ ইন্দ্রিয়সমূহই তাকে প্রাণীরূপে বাঁিচয়ে রাখে। কোনো একটি বা একাধিক ইন্দ্রিয় নষ্ট হয়ে গেলে তার বেঁেচ থাকা না বাঁচার মতোই হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রাণী তার চলার পথ চেনে, শত্রুকে বুঝতে পেরে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, খাদ্য থেকে অখাদ্যকে পৃথক করে এবং একে অপরের কাছে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। ইন্দ্রিয় বলতে আমরা প্রধানত চোখ, কান, নাক-এ অঙ্গগুলোকে বুঝি। এগুলো ছাড়াও পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে জিহ্বা এবং ত্বকও রয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট প্রাণীর সব ইন্দ্রিয় আমাদের গোচরীভূত হয় না। কিন্তু এগুলো তাদের দেহে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আছে। প্রাণী যত ক্ষুদ্রই হোক, তার ইন্দ্রিয়সমূহ সদা তৎপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের এ শক্তি মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তির চেয়ে বহুগুণ সক্রিয় ও প্রখর। ছোটো-বড়ো, হিং¯্র-অহিং¯্র প্রাণী যাদেরকে আমরা ইতর প্রাণী বলি, তারা কিন্তু তাদের ইন্দ্রিয়সমূহকে নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে পারে।
ইন্দ্রিয় প্রশ্নে মানুষ বেশ এগিয়ে। পঞ্চেন্দ্রিয় ছাড়াও মানুষের আরো কিছু ইন্দ্রিয়জাত শক্তি রয়েছে যেগুলোকে আমরা পৃথক পৃথক ভাবে মন, হৃদয়, আত্মা, ইচ্ছা ইত্যাদি বা সম্মিলিতভাবে বিবেক-বুদ্ধিপ্রসূত সায় বলে থাকি। বিশ্লেষকরা অবশ্য এগুলোসহ মোট চৌদ্দটি ইন্দ্রিয়ের কথা বলে থাকেন। যা হোক, জীবন সত্তার প্রাণকাঠি এ সম্ভারের অধিকারী হয়ে এ ইন্দ্রিয়গুলোকে কি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি? কেউ কেউ পারেন; কিন্তু আমরা অধিকাংশই তা পারি না। এ না পারার কারণে আমরা মানুষ হয়েও ঠিক মানুষ থাকি না; অন্য কোনো স্তরে চলে যাই। আমাদের চারপাশে শত অন্যায়-অনাচার থাকলেও তা আমরা দেখি না, দেখলেও অপরাধ হিসেবে নিই না। অন্যদিকে সত্য ও সুন্দর অনেক কিছু আমাদের কাছাকাছি বিচরণ করলেও সেসব আমরা দেখতে পাই না, দেখলেও কদাকার মনে করি। সুমধুর কোনো আওয়াজ বা আহ্বান ভেসে এলে সেদিকে কান দিই না, সযতেœ পরিহার করি। বরং কোনো খিস্তি-খেঁউড় শুনলে সেদিকে প্রবলবেগে ধাবিত হই। আমরা সত্যকে সুন্দর হিসেবে নিতে পারছি না; অসুন্দরকেই শোভন হিসেবে গ্রহণ করছি। আমাদের মন এবং বিবেক-বুদ্ধি সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ এর পার্থক্য নির্ণয় করছে না বা করতে পারছে না। আমরা মিথ্যাকে সত্যের সাথে মিশেল করে দিচ্ছি বা ¯্রফে মিথ্যাকেই সত্য হিসেবে হাজির করছি। এতে আমাদের আত্মা মোটেই কাঁপছে না। এতে বোঝা যায় আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ সঠিকভাবে কাজ করছে না, ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রবণতা সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন-তেমন, উচ্চবিত্ত কাতারের লোকদের মধ্যে প্রকট এবং রাজনীতির কাছাকাছি লোকদের বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের মাঝে প্রকটতররূপে দেখা যায়।
ঘটমান কিছু নমুনা দেখলে বিষয়টি দৃঢ়মূল হয়। বাজারে নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী মূল্যে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে পেয়াজ-রসুন, তেল-ডাল, আটা-চিনি কোথাও স্বস্তি নেই। তাও দাম আজ যা আছে আগামীকাল যে তাই থাকবে, বাড়বে না এরূপ ধরে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ক্রমাগতই বাড়ছে। আজ আলুর তো কাল ডিমের, পরশু মোরগের। প্রতিদিনের অত্যাবশকীয় এসব খাদ্যপণ্যের বাজারে যে চাহিদা এবং সরবরাহের গড়মিল নেই, বরং কালো হাত রয়েছে কিছু মানুষের, তা সবাই বোঝে। কিন্তু মানব সৃষ্ট এ রাহাজানি কি রাষ্ট্র্রের কর্তা ব্যক্তিরা দেখতে পান? তারা তো বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ফলে তারা বাজারের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারবে। তাদের উপলব্ধি-মানুষের গায়ে তো কাপড় আছে, হাতে মোবাইলও আছে। তারা কষ্টে কোথায়, তারা তো বেহেশতে আছে। তাঁদের এ মূল্যায়ন সঠিক না পরিহাস, তা যারা নিয়মিত বাজারে যান তারা হাড়ে হাড়ে টের পান। প্রায় মানুষই আধা কেজি করে সবজি কিনে বাড়ি ফেরেন এবং দোকানীরা বসে বসে পরিমাপ করেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। সাধারণ মানুষের যা অল্প-স্বল্প সঞ্চয় ছিলো, তা ইতোমধ্যে নি:শেষ হয়ে হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এখন বাজার ফর্দ এক রকম কাটছাঁট করে চলা। কিছুদিন পর তাদের কোনো কিছু বিক্রি করা বা ঋণ-দাদন করা কিংবা আত্মীয়-পরিচিতদের কাছে লুকিয়ে হাত পাতার যোগাড়। আর নি¤œবিত্ত, দরিদ্র, অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর পিছু নিয়েছে অপুষ্টি এবং বিভিন্ন অসাধু পন্থার চিন্তা। বাজারের এরূপ বর্ণনা কোনো আবেগী বয়ান নয়; এটা নির্লোভ অর্থনীতিবিদ এবং জরিপকারীদের তথ্য।
কিন্তু এসব তথ্য-ভাষ্যকে তো কর্তাব্যক্তিরা আমলে নিচ্ছেন না। তারা মনে করেন এসব অপপ্রচার; মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টামাত্র। আসলে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত। তারা কোনো কিছুই পরিষ্কার দেখতে পারছেন না, শুনতে পারছেন না, উপলব্ধিও করতে পারছেন না। এই না দেখা, না শোনা, না বোঝার ব্যাধি উচ্চ মার্গে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। লক্ষণ থেকে বোঝা যায় এ ব্যাধি মন-মস্তিষ্ক এবং বিবেকের কোটরে স্থায়ী আসন করে নিচ্ছে। বলা হচ্ছে দেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে এবং এবারও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচন সংক্রান্ত এ বয়ান একটা নাদানও বিশ্বাস করে না। অথচ এ আজব বাণী আমাদের অহর্নিশ শুনতে হচ্ছে এবং বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে। আমাদের চিন্তা এবং নৈতিক বৈকল্যের আরও নমুনা দেখুন। ক’দিন আগে দেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় বলেছেন, দুর্নীতির ফলে দেশের আর্থিক কোনো ক্ষতি হয় না। তার বাণীর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে দুর্নীতি করে টাকা কামায় সে তো পদ্মাপারে গিয়ে বেশি দামে ইলিশ কিনে খায়। ফলে লাভবান তো ওই এলাকার গরীব জেলেরা হচ্ছে। তাতে সার্বিকভাবে কোনো ক্ষতি নেই, লাভই তো হচ্ছে। এটা শুনে হাসেন বা কাঁদেন যাই করেন, অর্থনীতির নতুন একটা তত্ত্ব তো পাওয়া গেলো। সম্প্রতি অবাক করা আরেকটি নতুন ধারণার আঁচ পাওয়া গেলো। সেটা হলো – কোনো কোনো বিশেষ ব্যক্তির মৃত্যুতে যেনো “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তারই নিকট ফিরে যাবো) যা কোনো শোক প্রকাশ বা দোয়া নয় তবুও তা বলা ঝুঁকিবহ হয়ে উঠছে। এরূপ চর্চা অব্যাহত থাকলে চিন্তা করতেই হয় আমরা কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
আমরা সামনে এগুচ্ছি না পেছনে টলছি কিছুই আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ, আমরা চোখে ভালো দেখছি না, কানেও রয়েছে বধিরতা এবং অনুধাবনে বন্ধ্যাত্ব। আমাদের ইন্দ্রিয় এবং ¯œায়ুজগতে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রাট। মানুষ যখন দীর্ঘকাল অন্যায়-অসত্য আবহে বাস করতে থাকে, তখন তার কাছে ওই পরিবেশ ও মানদন্ডই সঠিক বলে বিবেচিত হওয়া শুরু হয়। তার ইন্দ্রিয়বিভ্রম হলেও এগুলোতেই সে তৃপ্তি লাভ করে। ইন্দ্রিয়সমূহ এভাবে অকাজে ব্যাবহৃত হতে থাকায় সেগুলো অসাড় হতে থাকে, কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। তাতে ক্রমাগত ময়লা জমে আবরণ এবং কালো দাগ পড়তে থাকে। কখনো সম্বিৎ ফিরলে চোখের ছানি অপারেশনের মতো আবরণ অপসারিত হয় এবং তখন সবকিছু পরিষ্কার দেখা এবং বোঝা যায়। কিন্তু আবরণটি সরাতে না চাইলে এবং পূর্বের আঙিনায় দৃঢ়মূল হয়ে পড়লে সে আবরণটিতে আরো ময়লা পড়ে তা ভারি আস্তরণে পর্যবষিত হয়ে পড়ে। এ আস্তরণের কারণে ইন্দ্রিয় সমূহে আলো প্রবেশ করতে পারে না। তখন কিছুই দেখা যায় না, শোনা যায় না, উপলব্ধি করা যায় না। তাই বলে আমাদের চক্ষুজোড় মুদিত হবে না; কানও খোলা থাকবে এবং হৃদস্পন্দনও চলবে। কিন্তু এ চলা তো চলা নয়। সে চোখে ভালো কিছু দেখা যাবে না, কর্ণকুহরে ভালো কথা প্রবেশ করবে না, হৃদয়-মনে ভালো কোনো চিন্তা স্থান পাবে না। মনে হবে সব ইন্দ্রিয়ে যেনো সীলগালা পড়ে যাচ্ছে। পবিত্র কোরআন সে কথাই জানান দিচ্ছে। সুরা আরাফের ১৭৯ নং আয়াতের একাংশে বলা হচ্ছে- “লাহুম কুলুবুল লা ইয়াফক্বাহুনা বিহা, ওয়ালাহুম আই’য়ুনুল লা ইয়ুবসিরুনা বিহা, ওয়ালাহুম আ’জানুল লা ইয়াসমায়ুনা বিহা”- তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দিয়ে দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে তা দিয়ে শ্রবণ করে না। আমাদের অবস্থা তো প্রায় সে রকমই। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সঠিক পথের সন্ধান আশু প্রয়োজন।
লেখক: প্রাবন্ধিক