বন্ধুবৎসল কবির প্রস্থান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ৬:০৫:০৫ অপরাহ্ন
আলফ্রেড খোকন
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী গত ৫ অক্টোবর কানাডার টরন্টোয় মারা গেছেন। কবির প্রতি শ্রদ্ধা।
কবি আসাদ চৌধুরী। আমার প্রিয় আসাদ ভাই। আমাদের দুজনের জন্ম বরিশালে হলেও তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ঢাকায়, ১৯৯২ সালে টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ার ঘাস চত্বরে। সেটা ছিল বিকেলবেলা। কবি শাহনাজ মুন্নী, সরকার আমিন, কবির হুমায়ূন, শাহেদ কায়েসসহ আমিও বসেছিলাম ঘাসে। তখন আমি ঢাকায় নতুন; তিলোত্তমা এ নগরে সেদিন আমার প্রথম দিন চলছে। হঠাৎ কাঁধে শান্তিনিকেতনী থলে নিয়ে ঝোড়ো গতিতে আমাদের দিকে চলে এলেন এবং যথারীতি বসে পড়লেন আসাদ চৌধুরী।
আমাকে ছাড়া সেখানে বসা সে সময়ের তরুণ কবিদের সবাইকেই তিনি আগে থেকেই চিনতেন। সরকার আমিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। নাম শুনে বললেন, ‘তোমার একটা কবিতা পড়েছি।’ এইভাবে তাঁর সঙ্গে আমার শুরু হয়ে গেল।
তারপর কত স্মৃতি, কত আড্ডা আর দিনযাপনের গল্প তৈরি হয়েছে, আজ তার কোনটা বলব? বলেই বা কী হবে, আসাদ ভাই তো আর শুনতে পাবেন না। আমাদের যেটা হয়, চলে গেলে মনে পড়ে। আর বেঁচে থাকতে যেন খানিকটা অলক্ষেই এড়িয়ে যাই মানুষটাকে; কাছেই তো আছে-এই ভেবে। কাছে থাকলে সম্ভাব্য শুন্যতা টের পাওয়া যায় না। আজ যেমন টের পাচ্ছি, আসাদ ভাই নেই! কানাডা থেকে এসেই আর কোনো দিন ফোন করে বলবেন না, ‘খোকন, আমি দেশে আছি, গতকাল আসছি। সব ভালো তো?’ কথাটার সঙ্গে কী যে মায়া এবং একখ- ছায়া জড়িয়ে ছিল, যা আর থাকল না।
আসাদ চৌধুরী এমন বন্ধুবৎসল ও হিতাকাক্সক্ষী মানুষ, যে মানুষেরা একটি সমাজে জন্মালে তাঁর সংস্পর্শে সে সমাজ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁকে আমরা বাংলা ভাষার ‘গোল্ডেন যুগ’-এর একটি এনসাইক্লোপিডিয়াও বলতে পারি। অনেক দশকের, অনেক শিল্পী, লেখক, রাজনীতিক ও নানা পেশার গৌরবোজ্জ্বল মানুষের সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে জানতেন। অত্যন্ত প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। শিল্পের প্রায় সব রকম শাখায় তাঁর জ্ঞানের পা-িত্য অতুলনীয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই কবি এত চমৎকারভাবে কথা বলতেন এবং কথা বলাটাও যে একটা শিল্প, তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন।
বই পড়া, গান শোনা, উপস্থাপনা করা আর পান খাওয়া ছিল আসাদ ভাইয়ের নিয়মিত কর্ম; বলা যায় নেশার মতো। পান খেতে খেতে তো একটি কাব্যগ্রন্থই লিখে ফেললেন, তবক দেওয়া পান। পান খাওয়াকে আসাদ ভাই শিল্পোত্তীর্ণ করে ছেড়েছেন। আসলে প্রকৃত শিল্পীর হাতে সবকিছুই শিল্প হয়ে ওঠে। মনে আছে, আসাদ ভাই একবার কলকাতা থেকে ফিরে আমাকে ফোন করে বললেন, ‘কলকাতা থেকে লোপামুদ্রা মিত্রের ক্যাসেট এনেছি। তুমি শুনে দেখো, ভালো লাগবে। ও কবিতাকে গান করেছে। দারুণ গলা।’ অন্যর গুণ দ্বিধাহীনভাবে প্রচার করায় তিনি ছিলেন অকৃপণ। বিশেষ করে, চেনা-অচেনা যেকোনো তরুণের গুণকে অকপট প্রশংসা করতে পারতেন তিনি।
বরিশালের উলানিয়ার জমিদারঘরের এক দুরন্ত কিশোর, একদিন যাঁর স্বপ্ন ছিল সিনেমা হলের ভেতর টর্চ জ্বেলে টিকিট চেক করে সিটে বসিয়ে দেওয়ার টিকিট চেকার হবেন; ইচ্ছা ছিল পানের দোকানদার হওয়ার, ইচ্ছা ছিল ওকালতি করার; তিনি শেষ পর্যন্ত হলেন কবি। আসাদ চৌধুরীর জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। তাঁর বন্ধুভাগ্য ঈর্ষণীয়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুর রহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক কিংবা রফিক আজাদসহ বাংলা ভাষার খ্যাতিমান অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর তাঁদের বন্ধুত্বের গল্প তো মিথের পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে আছে।
রণেশ দাশগুপ্তের হাত দিয়ে প্রথম দৈনিক সংবাদ-এ আসাদ ভাইয়ের কবিতা ছাপা হয়েছিল কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বার নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে। অবশ্য সাহিত্য পাতায় নয়, সম্পাদকীয় বিভাগে ছাপা হয় তাঁর প্রথম কবিতা। তাঁর একটি ভীষণ জনপ্রিয় কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’। আরেকটি জনপ্রিয় কবিতা হলো ‘শহীদদের প্রতি’।
মানুষ বা কবি হিসেবে আসাদ চৌধুরীর নিরিখটা ধরতে চাইলে আমাকে একবার নজর দিতে হবে তাঁর ‘এক্কাদোক্কা’ নামের একটি ছড়াকবিতার কাছে-‘ট্রেন যায় হিশ্ হিশ্/ বায়ু যায় ফিশ্-ফিশ্/ চোর যায় চুপচাপ/ দিন যায় ধুপধাপ/ গরিবের দিন যায়/ কী ক’রে, কী ক’রে, কী ক’রে?/ জানিবার সাধ হলে/ হাত দাও শিকড়ে, শিকড়ে, শিকড়ে।’ এটাই আসাদ চৌধুরী গভীর নিরিখ। তাঁর কবিতায় দেশ আছে, দেশের মানুষ আছে, সত্যভাষণ আছে। তিনি যখন ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতাটি লেখেন, বাংলাদেশের বর্তমান এবং মাতৃভূমির বেদনা যেন উথলে ওঠে তার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে:
‘তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
দীপ্তি ছিল-
এই যাওয়াটাই সুখের
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়,
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কার্নিশে কি ধূসর শাখে,
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
একটা জীবন ধরে তিনি একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠার চর্চা করেছেন। সুস্থ-সুন্দর সংস্কৃতির বিকাশেও তাঁর অবদান অনেক। আসাদ ভাই নিজেই বলতেন কথাটা, ‘আমি কেমন কবিতা লিখেছি, সেটা আমার কাছে আলোচনার বিষয় নয়, আমি শুধু একটা জীবন ধরে একজন সত্যিকারের মানুষ হতে চেয়েছি।’ এটা ঠিক যে কবিতার টিকে থাকা বা না থাকা নির্ণয় করবে আগামীকাল। আসাদ চৌধুরীর কবিতা কত দিন টিকে থাকবে, সেটা অনাগতকালের পাঠকেরা জানবেন। কিন্তু বেঁচে থাকতে তিনি জীবনকে, কবিতাকে এত বর্ণাঢ্যভাবে উদ্যাপন করেছেন যে সেখানে অতৃপ্তির তেমন কিছু নেই।
আসাদ চৌধুরীর আরেকটা গুণের কথা বলি। কোনো বিষয় কথা বলতে হবে, আসাদ ভাইকে শুধু শিরোনামটা বলে দিলেই হতো। তা সে বিজ্ঞান হোক আর শিল্পকলাই হোক। টেলিভিশনমাধ্যমে কাজের সুবাদে আমি দেখেছি নিরহংকার এক আসাদ চৌধুরীকে। বিশেষ দিবসের বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের নির্ধারিত অতিথি হঠাৎ অসুস্থ হয়েছেন, আসাদ ভাইকে ফোন করেছি, নির্দ্বিধায় সিএনজি নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। বলেছেন, ‘এখন গাড়ি পাঠালে সেই গাড়ি আসবে তারপর রওনা দেব, তোমার সময় কুলাবে না। আমি সিএনজি করে চলে আসছি, অপেক্ষা করো।’ এই আসাদ ভাইকে আমরা আর পাব না। তবক দেওয়া পান নিয়ে তিনি আর আসবেন না। আর দেখা হবে না প্রিয় আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে-কখনো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, কখনো বা বইমেলায় হঠাৎ একজন প্রয়োজনীয় অগ্রজের হাত আর আমাদের কাঁধ স্পর্শ করবে না।
আমরা হারালাম গুণবান, জ্ঞানবান, আদর্শে অবিচল, আস্থার এমন মানুষকে, যাঁর শুন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়।
আসাদ চৌধুরীর জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, উলানিয়া, বরিশাল, বাংলাদেশ।
মৃত্যু: ৫ অক্টোবর ২০২৩, আসোয়া, কানাডা।
উল্লেখযোগ্য বই: তবক দেওয়া পান (১৯৭৫); বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬); প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬); জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২); কোন অলকার ফুল (১৯৮২); যে পারে পারুক (১৯৮৩); বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮); বাড়ির কাছে আরশিনগর: বাংলাদেশের উর্দু কবিতা (২০০০); কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩)। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫); অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২); বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭); একুশে পদক (২০১৩)