গণতন্ত্র, নির্বাচন ও জাতীয় ঐকমত্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ২:৩৪:০৮ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট আনসার খান
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ওই নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে, নাকি দলনিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারী দলের সাথে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল দাবি করে আসছে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা একদমই নেই, বরং নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতাসীনরা আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা করবে বিধায় জনগণ যাতে ভয়মুক্ত পরিবেশে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে; সেজন্য একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট দীর্ঘসময় ধরে আন্দোলন করে আসছে এবং তাদের দাবি আদায়ের জন্য অনড়ভাবে আন্দোলন করে চলেছে। এখনো পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী দলগুলো নিজেদের অবস্থানে অটল থাকায় সরকার ও সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা তীব্রতর হয়েছে বলে রাজনীতি সচেতন মানুষেরা মনে করছেন।
উভয়পক্ষের এই অনড় অবস্থানের কারণে রাজনীতি, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক শাসন, জনগণের শাসক ও প্রতিনিধি নির্বাচনের মৌলিক অধিকার অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হওয়ার পাশাপাশি জনজীবনেও দুর্যোগ-দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। তাই দেশ, জাতি ও জনস্বার্থেই রাজনৈতিক সংকটের একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করতে হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধান করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মূল দায়-দায়িত্ব সরকার ও সরকারি দলকেই নিতে হবে এবং বিরোধী দলগুলোকে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, গণতান্ত্রিক শাসনে এটাই রীতি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন বিদ্যমান, যদিও বাস্তবতা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। যেহেতু দেশটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেহেতু গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শ ও নীতিগুলো মেনে চলাও বাধ্যকর। আমরা জানি, গণতন্ত্রে জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস এবং মালিক। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং গণতন্ত্রের বিশুদ্ধ তত্ত্ব অনুসারে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার বা শাসক জনগণের পক্ষে জনগণের প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যবহার করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। অর্থাৎ গণতন্ত্রে জনগণের বিঘোষিত সম্মতিই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি এবং সেই অনুযায়ী সরকারের কার্যনির্বাহীজনিত অধিকারের সূত্র হলো প্রকৃত জনসম্মতি, যা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, স্বাধীন মানুষের স্বাধীন সম্মতিই সরকারের ন্যায়সম্মত বৈধ ক্ষমতার নৈতিক ভিত্তি। এই অর্থে একটি সরকার তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা পালনে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ ও জবাবদিহি করতে বাধ্য এবং জনগণ ইচ্ছে পোষণ করলে, সরকারের পরিবর্তন করতে পারে এবং এই সরকার নির্বাচন বা সরকারের পরিবর্তন করার জন্যেই গণতন্ত্রের অভিযাত্রার বিকাশের পর্যায়ে নানা বিবর্তনের পথপরিক্রমায় ‘এক ব্যক্তির, এক ভোট’ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সম্মতি ও স্বাধীন ইচ্ছে প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো, সর্বজনস্বীকৃত, গ্রহণযোগ্য, আন্তর্জাতিক মানদ-ে অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, ভয়-ভীতিমুক্ত ও কারচুপিমুক্ত গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এধরণের একটি নির্বাচনী ব্যবস্থায়ই জনগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রতিনিধি ও সরকার নির্বাচন করতে পারে বা স্বীয় পছন্দের প্রকৃত বিকল্প প্রতিনিধি বা শাসক নির্বাচনের সুযোগ পেয়ে থাকে। এধরনের সৎ, স্বচ্ছ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই স্বাধীন মানুষের স্বাধীন সম্মতি ও জনগণের প্রকৃত আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তি প্রকাশিত ও প্রতিফলিত হতে পারে।
কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন সর্বজনীন সমানাধিকারের আলোকে প্রতিনিধি বা শাসক নির্বাচনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তখন সেই নির্বাচনের অর্থ দাঁড়ায় ভোটার জনগণকে বলা হচ্ছে তারা যেন ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিনিধি পছন্দ করেন তা যেন গোপন ব্যালটে ঘোষণা করেন বা তাদের ইচ্ছের কথা জানিয়ে দেন। স্বাধীন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগের এই ক্ষমতাবলে জনগণ নিজেদেরকে শাসক ও জনপ্রতিনিধিদের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রভূত্ব নিশ্চিত করে থাকেন। সাদাসিধে কথায়, জনগণের রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশের মাধ্যমই হলো এক ব্যক্তির, এক ভোট ভিত্তিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
গণতন্ত্র এবং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অনেক কিছুই নির্ভর করে সাধারণ নির্বাচন কিভাবে পরিচালনা এবং অনুষ্ঠান করা হয়েছে তার ওপর। নির্বাচন অনুষ্ঠান ও পরিচালনা যদি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষতার সাথে করা না হয়, জনগণ যদি নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দ বাছাই করার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তবে নির্বাচন ব্যর্থ হয় এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার এই ব্যর্থতায় জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার যেমন প্রকাশ ঘটে না, তেমনিভাবে গোটা গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে থাকে। তাই গণতন্ত্র ও জনগণের রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার সুরক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানদ-ে স্বীকৃত স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা, যেখানে সকল জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি ভয়-ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোটারগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এবং ভোটারদের প্রদত্ত ভোটের মতামত যাতে অবিকৃত অবস্থায় প্রতিফলিত হতে পারে এবং জনগণ যাতে নিজেদের পছন্দের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারেন, তার জন্যই আবশ্যক শক্তিশালী নির্বাচনী পদ্ধতি ও কাঠামোর।
বাংলাদেশ পাঁচ দশকেরও অধিক সময় পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা ও কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতিকদের, জনগণের নয়। আর ওই নির্বাচনী কাঠামো গড়ে না ওঠার কারণে ৫২-বছর ধরেই দেশে বারবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাত-সংকটের অবতারণা হয়েছে এবং ঝরেছে মানুষের জীবন ও রক্ত। রাজনীতিকরাই দাবি করে থাকেন বিগত কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সকলের নিকট সমান গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যারা ক্ষমতায় গিয়েছে তাদের ভাষ্য নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে এবং পরাজিত পক্ষ বলছেন ঠিক তার বিপরীতটা।
দেশের আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও দেশের রাজনীতিতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা গভীর থেকে গভীরতর হতে চলেছে এবং এমনকি সংঘাত-সংঘর্ষেরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আমাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ আছে, এর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন আছে। জোর করে ভোটে জয় লাভ করার, ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার বা দিনের ভোট রাতে করারও অভিযোগ আছে। বিস্তর এই অভিযোগ ওঠার পেছনে রয়েছে নির্বাচনী কাঠামোর ত্রুটি, দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য না থাকা বিধায় শক্তিমানদের বিশেষকরে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের প্রভাবে অনেক সময় গোটা নির্বাচন প্রভাবিত হয়ে থাকে, ভোট অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নির্বাচন কমিশন, ভোটের মাঠে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিরাপত্তার কাজে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কাজে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় এবং সবার সম্মিলনে ভোটের কারচুপি করে একটি পক্ষকে জয়যুক্ত করতে সহায়তা করে এবং এমনকি জনগণের প্রদত্ত ভোটের রায় পাল্টে দিয়ে থাকে বা অনেক সময় অর্থ, অস্ত্র ও ধর্মের অপব্যবহার করে ভোটারদেরকে ভোট প্রদানে বাধ্য করা হয়। ভোট পরবর্তীতে তাই ভোটের ফলাফল ও গ্রহণযোগ্যতাকে কেন্দ্র করে পরাজিত পক্ষ আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সংকট রাজপথেই থেকে যায় এবং রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংকটের সমাধান খুঁজা হয়। এতে করে দেশের গণতন্ত্র প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ৫২-বছরেও।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি মজবুত ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি ও কাঠামো গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিকদের মানসিকতার পরিবর্তন করা যেমন একান্ত অপরিহার্য, তেমনি এক ব্যক্তি নির্ভর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরও নির্ভরতা পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে বড় সংকট হলো পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব, কেউ কাউকে বিশ্বাস ও আস্থায় নিতে পারে না। তাই বিশ্বাসের এই সংকট গোটা রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনীতিকদের মধ্যে বিরাজমান পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার মনোভাব দূর করে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কের মনোভাব নিয়ে বিশ্বাসবোধ সৃষ্টি করতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাসবোধের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পদ্ধতি ও প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাকল্পে চলমান রাজনৈতিক ও নির্বাচন সংক্রান্ত পদ্ধতি ও ব্যবস্থার মৌলিক জনউপযোগী সংস্কার সাধন করতে হবে। এই সংস্কার ও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মৌলিক লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ, যেমন, আইন, শাসন এবং বিচার বিভাগকে যথার্থ ভাবে গণতান্ত্রিক নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসা। এগুলোর সত্যিকার গণতন্ত্রায়ন করা সম্ভব হলে রাষ্ট্র একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে, গণতন্ত্র ভিত্তিশীল ও শক্তিশালী হবে এবং এর ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনীতিকদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় ও কাঠামোতে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিবেশ ফিরে আসবে।
দেশের সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা, বিশ্বাসযোগ্য জনঅংশগ্রহণমূলক, এক ব্যক্তির এক ভোট, ভিত্তিতে গোপন ব্যালটে অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি আইনত স্বীকৃত হলেও এখনও অব্দি দেশে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন হয়নি বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। ফলে গণতন্ত্রের জন্য উর্বর মাঠ থাকা সত্বেও দেশে আন্তর্জাতিক মানদ-ে স্বীকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তার দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি, এই না হওয়ার জন্য জনগণ নয়, দেশের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী।
দেশের জনগণের মধ্যে ভোট একটি উৎসবের মতো, মানুষ স্বাধীন ভাবে তার পছন্দসই দল ও প্রতিনিধিকে নির্ভয়ে ভোট দিতে চায়। সত্তরের নির্বাচন দেখেছি কি উচ্ছ্বাস, আনন্দে মুখরিত নারী-পুরুষ ভোর হওয়ার আগে থেকেই ভোট কেন্দ্রে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কারো চোখ রাঙানো ছাড়াই নির্ভয়ে ভোট দিয়েছে। কিন্তু গত ৫২-বছর ধরে কী দেখছি? ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস, আনন্দ নেই, বরং চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখা গেছে ভোট এলে।
মূলত বাহান্ন বছরের বাংলাদেশে রাজনীতিতে মাস্তানতন্ত্রের চর্চা যে পরিমাণে দেখা গেছে, তার সিকিভাগও গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা হয়নি দেশে। এখানে রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ন, অর্থ-অস্ত্র এবং রাজনৈতিক চর্চায় ধর্মীয় উগ্রবাদীতার বিভৎসতার চিত্র ও রূপ দেখেছেন দেশবাসী। এসব দেখতে-দেখতে জনগণ মূখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে এবং রাজনীতির এই শূন্য মাঠ পূরণ করে চলেছেন একশ্রেণীর লুটেরাগোষ্ঠী।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে লুটেরা রাজনীতি আছে, তবে জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্রের রাজনীতি উধাও হয়ে গেছে সেই কবে। ফলে ভিত্তিমূলেই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতার দ্বারা গণতন্ত্রের রক্ষী হিসেবে গণতন্ত্র এবং নির্বাচনী বটবৃক্ষ বিকশিত করার সূযোগ তৈরি করতে পারেননি রাজনীতিকগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে শোষিতের গণতন্ত্র, শোষণের গণতন্ত্র, জনগণের অংশগ্রহণে গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা অভিধায় গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে লোক ঠকানোর সব ব্যবস্থা পাক্কা করে রাজনৈতিক দলের ওপর, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ব্যক্তির আধিপত্য স্থাপন করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ব্যক্তিগতকরণ, পরিবারকরণ, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, মাস্তানিকরণ ও অর্থের প্রাধাণ্যকরণের রূপ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সকল কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে জনগণকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু লোকজনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষেত্রের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে রাজনীতি এখন ওই কয়েকটি উপাদানের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে আছে।
এই বৃত্তাবদ্ধ রাজনীতিকে বের করে নিয়ে এসে একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্র, জনগণের ভোট উৎসবের গণতান্ত্রিক শাসনে রূপান্তরিত করা কোনো একক রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না, তাই দরকার সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ সহ সকল সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে কিছু মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া রাজনীতির সংস্কার, কার্যকর জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং জনগণের উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনা একেবারেই অসম্ভব। এটাও বলা সঙ্গত হবে যে, নির্বাচন নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকলে বিদেশিশক্তিগুলোও আমাদের নির্বাচন নিয়ে নাক-গলানোর সুযোগ পাবে না।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক