উন্নয়নের মহাশত্রু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ২:৪৩:৫৪ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
কথায় আছে নতুন খবর, পুরানো খবর, সমসাময়িক খবর বা সাম্প্রতিক খবর ইত্যাদি। আজ কয়েকটি পুরানো খবরের শিরোনাম নিয়ে শুরু করছি। খবরগুলো পুরানো হলেও নতুনের স্বাদ মেলে। খবরগুলোর শিরোনাম-
(এক) ‘সূর্যের উদ্দেশ্যে উড়াল দিল আদিত্য এল ১’ ( দৈনিক জনকন্ঠ ৩.৯.২০২৩)
একই পত্রিকার একই তারিখে পাশাপাশি আর একটি শিরোনাম-
(দুই) ‘রাজস্থানে নারীকে বিবস্ত্র করে গ্রাম ঘোরালেন স্বামী।’
ভারত তথা বিশ্ববাসীর জন্য একটি খবর গৌরবের আর একটি লজ্জার তথা কলঙ্কের। এখানে গৌরবের দিকটি হলো, সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ক’দিন আগে ভারতের শ্রহরিকোটা শহরের লঞ্চপ্যাড থেকে গত ১৪ জুলাই চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলা ‘চন্দ্রযান-৩’। যাত্রার ৩৯ দিন পর ২৩ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণে সক্ষম হয় নভোযানটি। ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্যকোন দেশের কেউ নাকি সেখানে অবতরণ করতে সক্ষম হননি। তারপর সূর্য। সূর্যের কাছে যাবার চিন্তা পৃথিবীর অন্যকোন দেশের কোন বিজ্ঞানী কল্পনা করেছেন কিনা জানি না। তবে ভারতের বিজ্ঞানীদের কল্পনা বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে দেখে ভারতের প্রতিটি মানুষ আনন্দে আপ্লুত যে হবেন তাতে কোন সন্দেহ নাই।
এর ফলে বিশ্বে ভারতে ভারতীয়দের মর্যাদা কতোটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে সেতো সহজেই অনুমেয়। সবার মুখে হাসিখুশী আনন্দ-উল্লাস। গগনবিদারি জনতার উল্লাস, বিশ্ব ছেড়ে মহাবিশ্বে পদযাত্রা ভারতবাসীর, হৃদয়ে হৃদয়ে মহামিলন অম্বরে বিজয়ী সুরের ধারায় অবগাহন ভারতবাসীর, আদিত্য-এল ১ এর নবযাত্রা নরনারীর অন্তরে অন্তরে নবনব আশার আলো বিশ্বকে পথ দেখায়, হারানো গৌরব, হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখে বিজয় লক্ষ্মী ভারতমাতা। উন্নয়নের জোয়ার বহে গঙ্গা, যমুনায়, সবই সত্যি সবই বাস্তব, অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। বিদেশে বসে উল্লাসে ফেটে পড়েন মোদীজী, প্রাণের সাথে মিলিলে প্রাণ, হৃদয়ের সাথে হৃদয়। হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল ভারতবাসীর প্রাণ।
কিন্তু রাজস্থানের সেই বিবস্ত্র নারীর হৃদয়ের কথা, প্রাণের কথার খবরকি কেউ রাখেন? আদিবাসী সেই নারীকে মারধরের পর বিবস্ত্র করে গ্রাম ঘোরানোর অভিযোগ উঠেছে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। এই ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার ওই নারী সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন।
সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন পুলিশ কর্মকর্তাগণ, ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট। তিনি বলেছেন-
‘
সভ্য সমাজে এ ধরনের অপরাধীদের কোনো স্থান নেই।’ প্রশ্ন জাগে- স্থান যদি না-ই থাকতো তাহলে এরা এলো কোথা থেকে? ওরা মণিপুরে ছিলো। এবার এলো রাজস্থানে। এসব রেকর্ড করা বাণীতে কী গ্রাম ঘোরানো বিবস্ত্র নারীর হৃদয়ের ক্ষত চিহ্ন কোন ডাক্তার মুছে ফেলতে পারবেন?
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহতারা বিজয়ের সুখবরটি কী ওই নারীর ভাঙ্গা মনে সুখবর বলে বিবেচিত হবে? কথায় বলে- যে সমাজে নারীদের মর্যাদা বেশি সে সমাজ, সে দেশ ততো সভ্য বলে বিবেচিত। রাজস্থানের সেই সমাজকে আমরা কি সমাজ বলবো? ঘটনার কারণ নাকি পরকিয়া। হতে পারে কিন্তু এই একই অপরাধ যদি ঐ নারীর স্বামী নামক জন্তুটি করতো তাহলে কী তাকেও বস্ত্রহীন করে গ্রামে ঘোরানো হতো? হতো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেটা করতো না। তারপরও মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলাট বাবুর কথায় আস্তা না রেখে উপায় নেই। সেটা যে শুধুই ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়, বিশ্বের সকল দেশের জন্যই দরকার। সমাজ-দেশকে সভ্য করতে অসভ্যদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।
(তিন) খবরটি দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার ১৬.৬.২০২৩ তারিখের ‘শিরোনামটি হলো-
‘পার্লামেন্টে যৌন হেনস্তার শিকার অস্ট্রেলিয়ার নারী এম.পি।’ প্রতিবেদনটির স্থিরচিত্রও তুলে ধরা হয়েছে
(ভাষণরত অবস্থায়)। নীচে লিখা রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে যৌন ‘হেনস্তার শিকার’ লিডিয়া থর্প। অস্ট্রেলিয়া তো অনেকটাই স্বপ্নের দেশ। সে দেশে দুঃস্বপ্নও দেখতে হয়। এমনটি হলে নারীরা কোথায় নিরাপদ। দুঃস্বপ্নটি হলো- নারী এমপি লিডিয়া থর্প এর যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া।
পার্লামেন্টের একজন নারী আইনপ্রণেতার যদি এমনি অবস্থা হয় তাহলে সেই স্বপ্নপুরীর চেহারা তো ভেসে উঠতেই পারে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সিনেটে দেওয়া ভাষণে থর্প বলেন, তিনি ‘যৌন মন্তব্য’ এর শিকার হয়েছেন। তাঁকে ‘কুপ্রস্তাব’ও দেওয়া হয়েছিলো বলে জানান। সিনেটর ডেভিড ভ্যানের বিরুদ্ধেও থর্প, অভিযোগ তুলেন। তবে সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হলো পরে সংসদীয় নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে নিজের ওই মন্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন লিডিয়া। এর পর পৃথিবীর দেশে দেশে নারী মর্যাদা নিয়ে কোন মন্তব্য করার প্রয়োজন রয়েছে। কোন মন্তব্য নয়, শুধুই নিবেদন আর আবেদন আমাদের এই সাধের গ্রহটিকে নারীবান্ধব করতে যেন আমরা সবাই একটু মনোযোগী হই। নয়তো চাঁদ সূর্যে গিয়েও আমরা সভ্যতার আলোকে আঁধারের দিকে ঠেলে দেবো। নিভিয়ে দেবো সোনার আলো। যদি চাঁদ সূর্যে কোন সভ্য জাতি থাকে তাহলে তারা আমাদেরকে কি আর বিশ্বাস করবে?
(চার) দৈনিক আমাদের সময়- ১৩.৯.২০২৩, খবরের শিরোনাম- ‘যুক্তরাজ্য, ওটিতে যৌন হেনস্তার শিকার নারী সার্জনরা’ এবার কি বলবো বলুন। গণতন্ত্রের সূতিকাগার, সভ্যতার পীঠস্থান বলে খ্যাত সেই ‘স্বর্গে’ নরকের একি দুর্গন্ধ নাসিকাকে সহ্য করতে হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক যে, দুর্গন্ধ যেটা স্বর্গেই হোক বা নরকেই হোক দুর্গন্ধ সে ছড়াবেই। আর স্বর্গ কখন নরকে পরিণত হবে সেটাই বা হলফ করে কেইবা বলতে পারবে। বিবিসি এর খবরে বলা হয়- জাতীয় হাসপাতালে নবীশ নারী সার্জন তাদের উচ্চ পদস্থ পুরুষ চিকিৎসক কর্তৃক যৌন হেনস্তার বা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এমন কি এমন নিপীড়নমূলক ঘটনা অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা চুপ থাকেন। তারা এই ভেবে আতঙ্কে থাকেন যে- তাদের কর্মজীবন বরবাদ হবে। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা জানিয়েছেন, গত ৫ বছরে দুই তৃতীয়াংশ নারী সার্জন স্বীকার করেছেন যে তারা তাদের সহকর্মীদের কাছে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
যে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যে একসময় সূর্যাস্ত হতো না তাদের নিয়ে আর কি-ই বা বলার আছে। চেয়ে চেয়ে দেখে যাওয়াইতো সার। লন্ডনে আমাদের দূতাবাস এর কর্তাব্যক্তিটি কী এ নিয়ে তথাকথিত মানবাধিকার শব্দটি উচ্চারণ করতে সাহসী হবেন? দেখা যাক, লন্ডনের কর্ণধার ঋষি সুনাক বাবু সেই ‘ওপেন সিক্রেট’ শব্দ দু’টি নিয়ে কি ভাবেন।
(পাঁচ) জনকন্ঠ ৭.৭.২০২৩, এবার একটু অন্যরকম খবরের শিরোনাম। ‘উপজাতি যুবকের পা ধুইয়ে ক্ষমা চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী।’
সচিত্র প্রতিবেদনের নীচে লেখা রয়েছে- হেনস্তার শিকার উপজাতীয় যুবকের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। বিষয়টি হলো- ‘মধ্যপ্রদেশের একজন উপজাতি ব্যক্তির মুখে ‘বিজেপি কর্মীর’ প্র¯্রাবের পর রাজ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং এর জেরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ভুক্তভোগী যুবকের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওই যুবকের পা ধুইয়ে দেন এবং তার কাছে ক্ষমা চান। এ সময় তাকে নিজের বন্ধু বলেও অভিহিত করেন মুখ্যমন্ত্রী।’ খুবই ভালো কথা, আশার কথা, ভরসার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কার পাপে কার শাস্তি? যে পাপী পাপ করলো, যুবকের মুখে প্র¯্রাব করলো সেই বিজেপি কর্মীটির কি হলো। সে তো ধরা ছোয়ার বাইরেই রইলো। সেই কুকর্মীর কুকর্মটিতো বিচারের আওতায় এলো না। মুখ্যমন্ত্রী মহোদয় যদি পাপীর পাপের দায়ভাগ নেন তাহলে তো উৎসাহিত হবে এমনতর কুকর্মে। শিবনাথ সিং যদি ঐ পাপীকে ধরে এনে অত্যাচারিত যুবকের পায়ের কাছে বসিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা করতেন তাহলে হয়তো বিজেপির তথাকথিত কর্মীদের সিং এমনিভাবে গজাতো না। নয় কি?
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা