ভারি বর্ষণ:
ঝুঁকিতে টিলার ঢালে বসবাসকারীরা, বাড়ছে প্রাণহানি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ১:২৮:৫০ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
সিলেটে কয়দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতার পানি হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় উঠে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন টিলার ঢালে বসবাসকারীরা। গত শনিবার ভোর রাতে শহরতলীর খাদিমনগর ইউনিয়নের খাদিম চা বাগান এলাকায় টিলা ধসে অর্চনা ছত্রী (১১) নামের এক স্কুল ছাত্রী নিহত হয়। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। জৈন্তাপুরেও বিভিন্ন স্থানে টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সাল থেকে এ নিয়ে সিলেট বিভাগে প্রায় ১৬ জনের প্রাণহানীর তথ্য পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সিলেটে ৬ জন, মৌলভীবাজারে ৮ জন ও হবিগঞ্জে ২ জন রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট সদর উপজেলার আখালিয়া, ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, টিলারগাঁও, খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, বালুচর, টুকেরবাজার, পাঠানটুলা গুয়াবাড়ী জাহাঙ্গীরনগর, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলাসহ বিভিন্ন স্থানে ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করছে কয়েক’শ পরিবার। এর মধ্যে কেউ ঘর ভাড়া নিয়েছে, আবার কেউ নামমাত্র টাকা দিয়ে দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা কিনে ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে নিম্ন আয়ের লোকজনই বেশি। বিভিন্ন টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার লোকের বসবাস। অন্যদিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও রয়েছে বেশকিছু পাহাড়-টিলা। সেগুলোর পাদদেশেও ঘর বানিয়ে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে গত বছর প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। চলতি বর্ষণে জৈন্তাপুরে অন্তত তিনটি টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি টিলার নিচে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের ভাটা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কয়েকটি টিলার প্রায় অর্ধেকই কেটে ফেলা হয়েছে। এর পাশেই অনেকে বহুতল ভবন ও টিনের ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। আখালিয়া বড়গুল এলাকার একটি টিলায় বেশ কয়েক বছর ধরে বসবাস করে আসছে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। টিলা কেটে বাড়ি তৈরি করায় দুর্বল হয়ে পড়েছে মাটির গঠন। তাই ভারি বর্ষণে তা ধসে পড়তে পারে যেকোনো সময়। ঝুঁকি জেনেও সেই টিলায় বসবাস করছে সহস্রাধিক লোক। তারা জানান, কম টাকায় জমি পাওয়ায় একটু ঝুঁকি নিয়েই ঘর বানিয়ে সেখানে থাকছেন। বড়গুল এলাকায় গেলে যে কারো চোখে পড়বে টিলা কেটে বাসাবাড়ি তৈরির দৃশ্য। গত শনিবার রাতে বড়গুলের পার্শ্ববর্তীপাড়া দুসকি এলাকায়ও একটি টিলা ধসের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া টুকেরবাজার ইউনিয়নের নালিয়া গ্রামে টিলা কেটে গড়ে উঠছে হাউজিং। গত দুই বছরে এ এলাকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। আখালিয়া বিজিবি ক্যাম্পের রাইফেলস ক্লাব সংলগ্ন টিলার নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। অবাধে টিলা কাটায় অনেকগুলো এরই মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: শফিকুর রহমান বলেন, টিলা কাটার বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই সোচ্চার। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আরো কঠোর হওয়া দরকার।
খাদিমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. দিলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ছোট-বড় বেশকিছু টিলা রয়েছে। সেগুলোর পাদদেশে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। বরাবরই তাদের সতর্ক করা হয়। তবে কে শোনে কার কথা। এবারো বর্ষণ শুরুর পর থেকে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের দিয়ে তাদের সতর্ক করেছি। নিয়মিত খোঁজখবরও রাখছি। তবুও খাদিম চা বাগান এলাকায় একটি অনাকাংখিত ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে তাদের দ্রুত সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার বলেন, ‘২০১১ সালে আদালতে এক রিট থেকে সিলেটের ছয় উপজেলাসহ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ হাজার ২৫টি টিলার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। যদিও বাস্তবে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনেক টিলার অস্তিত্বই নেই। ভূমিখেকোরা টিলা কেটে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে।
তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য চাইলে কেউই আসল তথ্য দেননা। কাগজপত্র দেখে সেই পুরনো তথ্য সরবরাহ করেন। তাদের হিসেব মতো টিলা সব জায়গাতেই আছে। বাস্তবে এতো টিলা কেটে ধংস লীলা চালালেও এর খোঁজ রাখেন না কর্মকর্তারা।
শাহেদা আখতার আরো বলেন, ‘টিলা কেটে ফেলায় প্রায়ই ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে। মূলত ২০২২ সাল থেকে প্রাণহানী ঘটছে। টানা বৃষ্টিতে ঝুঁকি সৃষ্টি হলেও বাসিন্দাদের সতর্কতায় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ টিলার নিচে বসবাস করছে। ভারি বর্ষণ হলেই কেবল তাদের নিয়ে একটু কথাবার্তা হয়, পরে সবাই ভুলে যায়। টিলার নিচে বসবাসকারীদের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।
ঝুঁকিপূর্ণ টিলা কিংবা পাহাড়ের নিচে যাতে কেউ বসবাস না করে, তথ্য অফিসের মাধ্যমে সে ব্যাপারে সচেতনতার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ইমরান হোসেন। তিনি জানান, তাদের প্রয়োজনীয় জনবল নেই। সীমিত জনবল দিয়েও মাঝে মধ্যে অভিযান চালান বলে দাবি করেন তিনি।