পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যার তিন বছর সাক্ষ্য ও জেরার বেড়াজালে বিচার প্রক্রিয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ৪:২৮:৫৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ (৩২) হত্যাকান্ডের বিচার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি ছিল সিলেটবাসীর। সিলেটের সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ এই দাবিতে আন্দোলনও করেন। কিন্তু দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম পড়েছে সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরার বেড়াজালে। বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি দূরের কথা উল্টো বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষ নানান চেষ্টায় লিপ্ত বলে অভিযোগ ওঠছে।
উচ্চ আদালতে মামলার স্থগিতাদেশের ভুয়া আদেশ সরবরাহের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ আগে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলেও সেই পুরাতন সাক্ষীকে আবারও জেরা করা হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নিহতের পরিবার। তাদের অভিযোগ, আসামিপক্ষ বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতে নানা টালবাহানা করছে। এর ফলে ন্যায় বিচার বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আজ বুধবার রায়হান আহমদ হত্যাকান্ডের তিন বছর হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি এডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরী সিলেটের ডাককে বলেন, আসামিপক্ষ আবারও পুরাতন সাক্ষীকে জেরা করছেন। এক আসামি উচ্চ আদালতে মামলা স্থগিতাদেশের ভুয়া কাগজপত্রও এনে দেন। বিচার বিলম্বিত করতে নানান চেষ্টা করা হয়েছে। এতে করে ন্যায় বিচার বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেটবাসীর মধ্যে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি সিলেট তথা দেশের একটি আলোচিত ঘটনা। রাষ্ট্রপক্ষ রায়হান হত্যা মামলা নিয়ে তৎপর আছে।
আর বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, আসামিরা শুরু থেকেই মামলা দুর্বল করতে চেষ্টা করে। এরপর বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতেও নানান চেষ্টা করে। না হয় এত সাক্ষী গ্রহণের পর কেন আবারও নতুন করে পুরাতন সাক্ষীকে জেরার জন্যে আবেদন করার মতো ঘটনা ঘটছে।
এদিকে, নিহত রায়হানের হতভাগ্য মা সালমা বেগম বলেন, আমার পুত্র রায়হান আহমদের খুনীদের বিচার চাই-ফাঁসি চাই। এ হত্যা মামলা থেকে রক্ষা পেতে দারোগা আকবরসহ আসামিরা শুরু থেকেই চেষ্টা করে আসছে। বিচার বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষের চেষ্টা এখনও চলমান আছে। আলামত নষ্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ করেও আসামি হাসান জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। আকবরও বেরিয়ে যেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আকবর জামিনে বের হলেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে চলে যাবে। রায়ের আগ পর্যন্ত যেন আর কোনো আসামি জামিনে বেরিয়ে যেতে না পারে সরকারের নিকট সালমা বেগম এই দাবি জানিয়েছেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মামলার মোট ৬৯ সাক্ষীর মধ্যে আদালত ৫৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। এরপর হঠাৎ করে আসামি কনস্টেবল হারুনের আইনজীবী পুরাতন ২৭ জন সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করার জন্যে আদালতে আবেদন করেন। বাদীপক্ষ এই আবেদনের বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি এডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরীও।
পিপি বলেন, এভাবে পুরাতন সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করা হলে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হবে। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত পুরাতন ৭ সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করার অনুমতি দেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পুরাতন এক সাক্ষীকে জেরা করা হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য রয়েছে বলে আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, পুরাতন ৭ সাক্ষীর জেরা আগামীকাল অথবা এর পরবর্তী তারিখে শেষ হয়ে যাবে। এরপর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করবে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল সোমবার তৎকালীন সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আবদুর রহিম পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে মামলার অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর রায়হান আহমদ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। এর আগে ওই বছরের ১২ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ থাকলেও সেটি পিছিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ গঠনের পর মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আদালত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন। এরপর নিহত রায়হানের গর্ভধারিণী মা সালমা বেগমসহ একে একে ৫৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেন প্রধান আসামি দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৫ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন। এর আগে ওই বছরের ৫ মে বুধবার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ৫ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২) (৩) ধারায় সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। টানা ২০২ দিনের তদন্ত শেষে দেয়া অভিযোগপত্রে দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রসহ কেস ডকেট ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠা। তবে মূল অভিযোগপত্র ২২ পৃষ্ঠার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে ৬৯ জনকে। সাক্ষীদের মধ্যে ১০ জন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
অভিযোগপত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভুঁইয়ার পুত্র দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়া (৩২), হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের পুত্র দারোগা হাসান উদ্দিন (৩২), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের পুত্র এএসআই আশেকে এলাহী (৪৩), সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের পুত্র কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের পুত্র কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়দেও (শমসেরনগর) গ্রামের ইছরাইল আলীর পুত্র সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানকে (২৬) আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভূঁইয়া, আশেকে এলাহী, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান আকবরকে পালিয়ে যেতে সহায়তাসহ আলামত নষ্ট করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোররাতে নগরের আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদ বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যায় রায়হান। মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যে দারোগা আকবরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা রায়হানকে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই দিনই ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। পরে ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। নির্যাতনে রায়হানের হাতের দু’টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলে দারোগা আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। নির্মম এই হত্যাকান্ডের পর ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সিলেটবাসী আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেন।
রায়হান হত্যার পরের দিন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২০। ধারা ৩০২/৩৪ দন্ডবিধি তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ১৫ (১) (২) (৩) ২০১৩। প্রথমে কোতয়ালী থানার এস আই আব্দুল বাতেন মামলাটি তদন্ত করেন। পরে তুমূল সমালোচনার মুখে ১৩ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর মামলাটি কোতোয়ালী থানা থেকে পিবিআই’র কাছে স্থানান্তর করে ।
এদিকে, ঘটনার পর আকবর হোসেন ভূঁইয়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ঘটনার ২৮ দিন পর ৯ নভেম্বর সোমবার সকালে কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত এলাকায় ভারতের অভ্যন্তরে খাসিয়াদের হাতে আটক হয় আকবর। পরে তাকে বিজিবি আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাকে গ্রেফতার করে সিলেটে নিয়ে আসা হয়।