পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
দেশবাসীর ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ৪:৩৭:৩৮ অপরাহ্ন
ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করাই সরকারের লক্ষ্য
আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়
আবারও জনগণের সেবার জন্য নৌকায় ভোট চাই
ডাক ডেস্ক : বাঙালি জাতির ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতিকে আমি আহ্বান জানাই, জাতির ভাগ্য নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে।’ তিনি বলেন, ‘এই দেশ আমাদের, আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। কাজেই জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে বিশ্বে এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া রেলস্টেশনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের রেলপথ উদ্বোধনকালে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি আমরা গড়ে তুলব। এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই এ দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। আর যারা নির্বাচনের ধোঁয়া তুলে আমাদের প্রতিদিন ক্ষমতা থেকে হঠায়, তারা কখনো অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। কারণ, তাদের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে একজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাত দিয়ে এবং ভোট চুরি করা ছাড়া কোনো দিন ক্ষমতায় আসে নাই। যে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ৩০০ আসনে মাত্র ২৯টি আসন পেয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, তার পর থেকে তারা নির্বাচন বয়কট আর নির্বাচন নিয়ে খেলা, অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ হত্যা, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা এই ধ্বংসযজ্ঞেই মেতে আছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ উচ্চারণ ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়ন বন্ধের পর আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, আজকে তা করে দেখিয়েছি। আবারও প্রমাণ করেছি, বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামান্য একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে পারবে না বয়সের কারণে, সেটা বলার জন্য বিশ্বব্যাংক তাঁর পক্ষে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপরই আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করব।’
‘পদ্মা নদী রেলে করে পাড়ি দেওয়া, আজকের দিনকে সেই স্বপ্নপূরণের দিন হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী চলমান বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে দেশের সব অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোয় আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে একটি মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। এ লক্ষ্যে তাঁর সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এরই মধ্যে ৮ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীনকে ভূমি ও গৃহ দিয়েছে। সব জেলা-উপজেলায় মডেল মসজিদ করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশকে আরও উন্নত করা। ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছি। আড়াই কোটি শিক্ষার্থী বৃত্তি, উপবৃত্তি পাচ্ছে। যাতে দেশটা এগিয়ে যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, এখন আমাদের লক্ষ্য, স্মার্ট বাংলাদেশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছি। ল্যাব করে দিয়ে কম্পিউটার শিক্ষা দিচ্ছি। লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং কর্মসূচির মাধ্যমে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারকে প্রশিক্ষিত করেছি। ব্রডব্যান্ড সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ায় তারা বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘরে বসে দেশবিদেশের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকের এই প্রকল্প, যেটা ভাঙ্গা পর্যন্ত এখন করেছি, সেটা ভাঙ্গা থেকে যশোরে সংযোগ হবে। আর যশোর থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এমনকি বরিশাল, পটুয়াখালী থেকে পায়রা পর্যন্ত এই রেললাইনকে যুক্ত করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।’ যদিও সেখানে মাটি নরম থাকায় কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে; তবে এ ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরকে সংযুক্ত করবে। প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা অংশ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে নতুন তিন জেলা মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় এল।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম। স্থানীয় সংসদ সদস্য (মুন্সিগঞ্জ-২) সাগুফতা ইয়াসমিন, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য দেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর।
অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল যোগাযোগের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এ সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান, প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মাওয়া রেলওয়ে স্টেশনে নতুন রেলপথের উদ্বোধনের পর কাউন্টার থেকে টিকেট কাটেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিনি নিজেই হুইসেল (বাঁশি) বাজান এবং সংকেত দেন ট্রেন ছাড়ার। পরে ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বেলা ২টায় ভাঙ্গা রেল জংশনে পৌঁছান। সেখান থেকে সড়কপথে বিকেল ৩টায় ডা. কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়ামে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তিনি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দেশকে বাঁচাতে এবং দেশ সেবার জন্য আরেকবার সুযোগ দিতে নৌকায় ভোট দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেন আবারও জনগণের সেবা করতে পারে সেজন্য নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপি-জামায়াত দেশকে ধ্বংস করবে এবং আমার দলই দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে।’
তিনি বলেন, আমি আজ আপনাদের উপহার দিচ্ছি, পদ্মা সেতুর পর পদ্মা রেল সেতু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌকা আপনাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। নৌকা পদ্মা সেতু-রেল সেতু দিয়েছে, রাস্তা-ঘাটের উন্নতি করেছে, নৌকা আপনাদেরকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দিচ্ছে, নৌকাই এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। তাই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যাতে আপনাদের সেবা করতে পারে আপনাদের কাছে আমার সেই আবেদন থাকলো।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াক আরিফের সঞ্চালনায় সমাবেশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
এদিকে, সমাবেশ শেষে বিকেল ৪টায় সড়কপথে ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে তিনি সেখানে পৌঁছে জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে জাতির পিতার সমাধির সামনে কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর তিনি বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়া দেশের অব্যাহত উন্নয়ন, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে ১নং গেট থেকে বের হয়ে টুঙ্গিপাড়ার নিজ বাসভবনে যান সরকারপ্রধান।