দেশপ্রেম জাগ্রত হোক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১০:০১:৩৭ অপরাহ্ন
গোলাম সারওয়ার
সৎ কর্মে কে অগ্রগামী, তা পরীক্ষা করার জন্যেই মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য জীবন এবং মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন। জীবন সৃষ্টির সাথে সাথে আমাদের মৃত্যুর তারিখ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়ার জন্যে যে পরীক্ষা, সেই পরীক্ষায় কি আমরা আছি? পরীক্ষা কিন্তু চলমান। কেউ আমরা পরীক্ষায় আছি বা পরীক্ষায় নেই।
ধেয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। খুব সম্ভব নভেম্বর মাসেই এর তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করুক, নাই করুক, নির্বাচন হবেই। নির্বাচনে যারাই জয়লাভ করবে তারাই দেশ পরিচালনায় থাকবে।
দেশের সংবিধান অনুযায়ীই জাতীয় নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিবেন। তবে এ নিয়ে আমাদের দেশে বর্তমানে বিরোধ চলছে। বিএনপি সহ কিছু অঙ্গ সংগঠন সংবিধানের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছেন। কিন্তু সরকার দলীয় আওয়ামী লীগ ও এর সাথে জড়িত আরো কিছু রাজনৈতিক সংগঠন সংবিধান অনুসারেই নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত এবং সেই মতে তারা প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
এই পাল্টাপাল্টি বিরোধের কারণে আমেরিকা ভিসা নীতি চালু করেছে। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয় তার জন্য এই ভিসা নীতি। অর্থাৎ যারা নির্বাচনে অংশ নিবে না, অথচ গ-গোলের সৃষ্টি করবে তাদের জন্য আমেরিকা প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকবে। অথবা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অসহিষ্ণু পরিবেশের সৃষ্টি হলে তাদের জন্যই আমেরিকা যাওয়ার প্রবেশ বন্ধ থাকবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আমেরিকার ভিসা নীতিতে নেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, সফল এবং নিরপেক্ষ হয় সেজন্য আরো কিছু দেশ ভিসা নীতি প্রয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। কারণ, ভিসা নীতিগুলো আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। দেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, ২৯ সচিবের ৪৩ জন সন্তান বিদেশে অবস্থান করছেন। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে-মেয়েরাও আমেরিকা এবং লন্ডনে বসবাস করছেন। এদেশের ধনকুবের মন্ত্রী আমলা বা শিল্পপতিদের সন্তানাদি বহু আগে থেকেই আমাদের সোনার বাংলা ছেড়েছেন। সোনার বাংলা ধরে আছি আমরাই, যারা এদেশের ভুখানাঙা, খেটে খাওয়া দরিদ্র সাধারণ মানুষ। ফলে যা হবার তাই ঘটছে। এদেশ থেকে অর্জিত সম্পদ সহজেই দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। ভুখানাঙা, দরিদ্র মানুষের জন্য শুধুই বঞ্চনা থাকছে। করোনার পর থেকে খুব দ্রুতগতিতে সোনার বাংলার সোনার ছেলেরা বিদেশকে সোনায় রূপান্তর করার জন্য সোনার বাংলা ছাড়ছে। খুব সহজেই নাকি কানাডা যাওয়া যাচ্ছে। এমবেসিতে উঠলেই নাকি ভিসা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যেভাবে এদেশে প্রবেশ করেছে তার চেয়েও নাকি ভয়াবহ গতিতে এদেশের সোনার ছেলেরা-সোনার মেয়েরা লন্ডন, আমেরিকা-কানাডা, নিউজিল্যা-, অষ্ট্রেলিয়া পাড়ি দিচ্ছে। ফলে দেশ শুধু মেধাশূন্যই হয়ে পড়ছে না বঞ্চনারও মুখোমুখি হচ্ছে।
যে কারণেই দেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। যে কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থা আজ অচলাবস্থায় পড়েছে। সচিব, মন্ত্রি, ধনকুবের বা শিল্পপতি বড় ব্যবসায়ীদের ছেলে-মেয়েরা যেহেতু দেশের বাইরে, তাহলে এদেশে উন্নয়ন করে কী লাভ?
দেশের প্রতি খুব দরদি বা দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা এখন খুবই কম। দেশপ্রেম থাকলে সংসদের বাইরে কেন থাকতে হয় বছরের পর বছর? আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই ক্ষমতার বাইরে থাকতে রাজী নয়। যে কারণে ওরা নির্বাচনে হেরে গেলে সংসদের ভিতরে জনগণের পক্ষে কথা বলতে চায় না। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিরোধী দল বলতে কিছু নেই। আছে শুধু ক্ষমতাসীন দল আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া আরো কিছু দল। অথচ দেশপ্রেমিক হলে ক্ষমতার বাইরে থেকেও দেশের মানুষের জন্য কাজ করা যেত। এই যে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি- এটা নিয়ন্ত্রণের দায় কি শুধু সরকারের? বেসরকারি দলেরও দায় এড়ানোর উপায় নেই। অথচ আমাদের দেশের বেসরকারি দলগুলো বড় বেশি উদাসীন।
হ্যাঁ, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। আমাদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার পড়েনি। ভোট বাক্স আপনা-আপনি ভরে গেছে। আমরা বলব বিরোধীদলগুলোর অংশগ্রহণ না করাই এর জন্য দায়ী। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি হলে আপনাদের দেখার কিছুই নেই। এদেশের জনগণ দেখবে, জনগণই এর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। জনগণের ওপর আস্থা থাকা উচিত ছিল আপনাদের। জনগণের ওপর আস্থা না রাখতে পারলে আপনাদের শক্তি আরো হারাতে হবে।
১৪-১৫ বছর সংসদের বাইরে থাকলেন, একবারও সংসদে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে পারলেন না জনগণের দাবি নিয়ে। এখন রাজপথে রোড মার্চ, সভা, মিছিল করে কি করবেন? এক দফা দাবিতে সরকার পতনের আন্দোলন কি গণতন্ত্রের পরিচয় বহন করে? ছিয়ানব্বই সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পরের প্রেক্ষিত এবং নব্বই সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিত কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটের সাথে মিলে না। সেই সময়ে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। এখন কিন্তু গণজাগরণ ঠিক সেইভাবে হচ্ছে না। এদেশের সাধারণ জনগণ এখন কিন্তু অনেক বুঝে। অনেক এনালাইসিস, অনেক ক্যালকুলেশন এখন জনগণের মাথায় আছে। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাও এখন পাবলিক বুঝে।
বাঘ কিংবা সিংহের গর্জনে বনের পশু-পাখীরা এতটা ভয় পায় না যতটা মানুষের কন্ঠস্বরকে ভয় পায়। সম্প্রতি সাউথ আফ্রিকায় একদল গবেষক এটা প্রমাণ করেছেন। অতএব আপনারা বজ্রকন্ঠ ধারণ করুন সংসদে। সংসদের বাইরে কন্ঠস্বর উচ্চারিত হলে পশু-পাখিরা আরো নিধন হবে। অন্তত পশু পাখীদের রক্ষায় আসুন আমরা সংসদের বাইরে নয়, সংসদের সুরক্ষিত কক্ষে বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলি দেশের মানুষের এবং বনের পশু-পাখিদের সুরক্ষার জন্য। সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়ার জন্য এটাও একটা পথ, এটাও একটা চেষ্টা, এটাও একটা দেশপ্রেম- কি বলেন আপনারা?
লেখক: কলামিস্ট