নিঃসঙ্গতাই শিশুদের বড় সমস্যা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৮:০৪ অপরাহ্ন

আফতাব চৌধুরী
বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ মনে পড়ে গেল বন্ধু সেলিমের কথা। আজ তার একমাত্র মেয়ে ডায়নার বার্থডে। গেইট খুলে ঢুকে গেলাম তাঁর বাড়িতে। বাড়ী খাদিমনগর এলাকার বাহুবল আবাসিক এলাকায়। রাত সবেমাত্র ৭টা। কিন্তু মস্তবড় বাড়িটা যেন একেবারেই নিঝুম। কোথাও কোনও জনপ্রাণীর সাড়া নেই। ‘বার্থডে’র বাড়িতে নেই কোনও হাঁকডাক, কোলাহল। আশ্চর্য হয়ে নিজেই হাঁকডাক শুরু করে দিলাম। ডায়না কোথায় রে। ভেতর থেকে কান্নাভেজা কণ্ঠে উত্তর শুনতে পেলাম, আঙ্কেল, আমাকে বাঁচান! ব্যাপার কী?
ভিতরে প্রবেশ করে দেখি ডায়না যেন হাজারো কেলেঙ্কারির প্রধান আসামী। আর তার মা দীপা যেন এক জাঁদরেল সিআইডি অফিসার। হাতে তাঁর একখানি সাদা চকচকে বাঁশের ছড়ি।
আমার উপস্থিতি টের পেয়ে দীপা ফিরে তাকাল। বলল‘দেখনা ভাই ও দুধ খেতে চাইছে না।’ দেখলাম, টেবিলে দুধের গ্লাস পড়ে আছে। সবটুকু দুধ গিলে ডায়নাকে এখনই পড়াশোনায় বসতে হবে। একালের ইংলিশ স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী সে। সুতরাং পড়াশোনার ধকলও তো কম নয়।
আমি ডায়নাকে তার এই আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। বললাম, আজ ও জন্মদিনের কেক খেয়েছে, সঙ্গে খেয়েছে আরও রকমারি অনেক কিছু। কাজেই আজ ওর দুধ না খেলেই ভালো হবে।‘তুমি বলছো কি ভাই? দুধ না খেলে ওর স্বাস্থ্য হবে কোথা থেকে,’ দীপা যেন অবাক হয়ে গেল। বললাম, হবে। দীপা কিছুতেই আশ্বস্ত হলো না। হতাশার সুরে বলতে লাগল ‘দেখোত ভাই, দিনে দিনে ও কেমন যেন রোগাটে হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ায় রুচি নেই। পড়াশোনায়ও মনমরা হয়ে যাচ্ছে।’ দীপা ও সেলিম আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী। ওদের সঙ্গে কলেজ জীবনেই পরিচয়। পরে বিয়েও করেছে সম্পর্ক করে। আমি তাদের সেই প্রেম পর্বের নীরব স্বাক্ষী। আর ডায়না হচ্ছে তাদের সেই প্রেমের প্রস্ফুটিত প্রথম কদম ফুল। সুতরাং, আমার কাছে দীপাদের অভিযোগ-অনুযোগের যথেষ্ট অবকাশ আছে। তবে, আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির প্রধান উপায় মনে করেন। গো-দুগ্ধ অবশ্য অতি উপাদেয় পদার্থ, কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করার শক্তির ওপর নির্ভর করে, এই জ্ঞান এই শ্রেণীর মাতৃকুলের নেই। তাদের বিশ্বাস, এই বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। কাজেই শিশু যদি তা গিলতে আপত্তি করে, তা হলে সে বাঁদর ছেলে। সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। অতএব যখন তখন তাকে ধরে-বেঁধে জোরজবরদস্তি দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। শেষে সে যখন এই দুগ্ধপান ক্রিয়া থেকে অব্যাহতি লাভ করার জন্য মাথা নাড়াতে, হাত-পা ছুড়তে শুরু করে, তখন ¯েœহময়ী মা জননী বলেন,‘আমার মাথা খাও, মরামুখ দেখো, এই ঢোক, আর এক ঢোক, এক ঢোক ইত্যাদি।’ মার উদ্দেশ্য যে মহৎ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বিষয়েও সন্দেহ নেই যে, ওই যে বলা-কওয়ার ফলে মা শুধু শিশুর যকৃতের মাথা খান এবং ঢোকের পর ঢোকে তার মরা মুখ দেখবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলেন।’ বর্তমানে আমাদের ইংলিশ স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতিটাও ওই এক ধরনের। এর ফলে কত ছেলেমেয়ের সুস্থ-সবল মন যে ইনফ্যান্টাইল লিভারের ‘গতাসু হচ্ছে, তা বলা কঠিন। কেননা দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যু রাখা হয় না।
দীপার অভিযোগের উত্তরে বললাম, ওকে খেলাধূলা করতে দাও। ওর দেহ ও মন এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাবে। দীপা বলল, ‘না ভাই ও খেলাধূলাও করতে ভালোবাসে না। শুক্রবারে ছুটির দিনে তো আমরা ওকে বলি, যাও, বাইরে থেকে কিছু খেলাধুলা করে এসো। তাতেও সে উৎসাহবোধ করে না। মোট কথা ও তার খেলার সাথী খুঁজে পায় না।’ অর্থাৎ, বাইরের শিশুদের সঙ্গে সে মিশতে চায় না, বা মিশতে পারে না। মনে মনে বললাম, জন্ম থেকে দাঁড়ে বসে যে পাখি দুধ ছোলা খেয়েছে, এখনও খাচ্ছে, সে ভুলে গিয়েছে যে, সেও উড়তে পারে। বাইরে তারই স্বজাতি পাখিকে উড়তে দেখে অন্য কোনও জীব বলে ভ্রম হচ্ছে। এই পিঞ্জরের পাখিদের দ্বার আর তো মুক্ত হবে না।
মুখে বললাম, ওর বয়স তো পাঁচ পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার ঘরেই ওর খেলার সাথী আমদানি করে দাও না?
নির্জন স্থানে যেন একটা বোমা ফাটল। দীপা আঁতকে উঠে বলল, ‘তুমি পাগল হয়েছ ভাই? একটাকেই সামলাতে পারছি না, হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপরে দু’টো। মগো, আমি পারব না ভাই। ডায়নাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে না জানি কত টাকা, কত খাটুনি যে লাগবে তার ইয়ত্তা নেই। তদুপরি তুমি বলছ আর একটা । না বাবা, না, ডবল ঝুঁকি নেওয়ার মতো এত বোকা মেয়ে আমি নই।’
সত্যিই তো। শুধু দীপা কেন, এই যান্ত্রিক সভ্যতার রমরমার যুগে কোনও দম্পত্তিই আর দ্বিতীয় ইস্যু মেনে নিচ্ছে না। হোক পুত্র বা কন্যা, এক বাচ্চাই যথেষ্ঠ। ১৫-২০ বছর আগেও দেখেছি, ছেলে পাওয়ার আশায় কেউ কেউ দ্বিতীয় ইস্যুতে উৎসাহ বোধ করত। কিন্তু আজকাল কেউ আর সে বোকামি করছে না। কেননা, সন্তানের কেরিয়ার গড়ে দেওয়ার প্রশ্নে সকলেই আজ ভীষণ সচেতন হয়ে গিয়েছেন। আর এ যুগে মেয়েই বা ছেলের চেয়ে কম কীসে? ফলে ঘরে ঘরে আজ একলতা বেটা আর একলতি বেটির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। অন্য কোনও কনিষ্ঠ সদস্যের প্রবেশাধিকার সেখানে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সকলেই অঙ্ক কষে একটি মাত্র সন্তান উৎপাদন করছেন, যাতে করে ওকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানো যায়। এখানে টাকা লগ্নি করা বা টাকা ব্যয় করার অঙ্কটাই প্রাধান্য পেয়েছে, সেই সঙ্গে খাটুনি ও ঝামেলার। অর্থাৎ কম খরচে বা কম খাটুনিতে অধিক মুনাফা লাভ করা। দু’টি সন্তানের কেরিয়ার গড়ার প্রশ্নে ডবল খাটুনি, ডবল পয়সা খরচ করার কী দরকার? বিশেষত, ইংলিশ মিডিয়ামে ত অবশ্যই পড়াতে হবে। ওখানে দু’টোকে নিয়ে টাকা-পয়সার ট্যানাহ্যাচড়া করার চেয়ে একটার পাতেই সমস্ত ঝোল ঝরে পড়–ক। আর গাড়ি তো বহু দুরের-যার সমাপ্তি ঘটবে একেবারে বিলেত পৌছে গিয়ে, ‘সাহেব মেম বনে গিয়ে। অন্য কথায়, কেবল টাকা রোজগারের মেশিনে পরিণত হয়ে গিয়ে। এই তো হলো, আমাদের দর্শন বা ফর্মুলা তথা সন্তানদের কেরিয়ার গড়ে দেওয়ার মানসিকতা। তাই ঘরে ঘরে আজ প্রতিটি পরিবারে দুই নম্বর তথা কনিষ্ঠ সন্তানের অভাবে নীরবতা বিরাজ করছে। তবে এতে করে প্রজন্ম কী হারালো, কতখানি হারালো এবং অদূর ভবিষ্যতে তারা আরও কী হারাতে যাচ্ছে- তা একটু খতিয়ে দেখতেই আমাদের আজকের এই নিবন্ধের অবতারণা।
এ যুগের শিশুরা দেহে মরা, মনে মরা দীপার এ অভিযোগের উত্তরে বলতে চাই, এর জন্য দায়ী এ যুগের অভিভাকরাই। অত্যন্ত স্বার্থপর, নির্মম এই অভিভাবকরা সন্তানের কাছ থেকে পরীক্ষায় শতকরা একশো ভাগ নম্বর আদায় করতেই ব্যস্ত। একভাগ কম হলে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, সবাইকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। সুতরাং ওরা হয়ে পড়েছে গ্রন্থকীট। প্রকৃতির মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস আহরণ করার অধিকার এদের নেই। বাইরে খেলাধূলা করারও উপায় নেই। ওরা যেন কলের পুতুল কিংবা কাঠের পুতুল। একমাত্র সন্তানের হিড়িকে ঘরেও এদের একটি মাত্রও খেলার সঙ্গী নেই। ফলে অনিবার্য কারণেই এদের দেহ-মন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তাই এদের কাছে সুস্থ, সবল, সচেতন দেহ-মন আশা করা শুধু বৃথাই নয়, অন্যায়ও বটে।
একশো ভাগ নাম্বার আদায় করেও এখানে থেমে থাকছে না। সেই সঙ্গে আমরা নবীন প্রজন্মকে ভীষণ নিঃসঙ্গ, ভীষণ একাকিত্বে ও নৈরাজ্যে ঠেলে দিচ্ছি। একলতা ও একলতির আতিশয্যে আমাদের এই নবীন প্রজন্ম ভাইবোনের ¯েœহ বা ভালোবাসা হারাচ্ছে। হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, শর্ত যেখানে একটিই ইস্যু, সেখানে প্রজন্মের কারও ভাই কিংবা কারো বা বোন থাকার তো কথা নয়। সুতরাং, ‘যম দুয়ারে দিয়া কাঁটা, ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোটা’ এ যুগের ভাই বিহীন হাজার হাজার ‘ডায়না’দের এ অতি ইচ্ছা নিরর্থক হয়ে গিয়েছে। অথবা, মান্না দে-র সেই বিখ্যাত গান- ‘ও আমার আদরের ছোট বোন’। কিংবা লতার ‘ও সাতভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে একটি পারুল বোন আমি তোমার’। যেখানে আজ একটি ভাইয়েরই অস্তিত্ব নিশ্চিহৃ হয়ে গিয়েছে, সেখানে সাতটি ভাইয়ের তো প্রশ্নই অবান্তর। আজকের দিনের এই একটি মাত্র সন্তান উৎপাদনের হিড়িকে ঘরে ঘরে প্রজন্মের ‘দাদা ডাক’, ‘দাদি ডাক’- এর একটা অধ্যায়ের সমাধি রচিত হয়ে গিয়েছে।
এ যুগে ভাই-বোন সম্পর্কের একটা অধ্যায় ধ্বংস করে দিলাম আমরা। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবটা কেউ চিন্তা করছেন কি? অর্থাৎ আজ ঘরে ঘরে ‘ডায়না’ বা ‘মিল্টন’রা একমাত্র হওয়ার সুবাদে তাদের অনাগত যুগের ছেলেমেয়েরা কাকে, কাকে হারাতে যাচ্ছে? ডায়নার কোনও ভাইবোন না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ তার গর্ভজাত সন্তান হারাবে ‘মামা’ বা ‘খালাকে’। অনুরূপভাবে মিল্টনদের ভাইবোন অবশিষ্ট না থাকায় তার সন্তানটি হারাবে ‘চাচা’ বা ‘ফুফুকে’। এক কথায় তারা মামা-মামি, ফুফা-ফুফু, খালা-খালু, চাচা-চাচি ইত্যাদি সকল নিকট আত্মীয়দেরই হারিয়ে ফেলবে।
অনাগত ভাবিষ্যৎ প্রজন্মের আক্ষরিক অর্থেই নিকট আত্মীয় বলতে যখন কেউই অবশিষ্ট থাকল না, আপনজনদের কোনও সান্নিধ্য রচিত হলো না, তখন ¯েœহ বা প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার উৎস বা সম্পর্ক খুঁজে পাবে তারা কোথায়? ¯েœহ-প্রেম-ভালোবাসা তো নির্জন ঘরের শূন্য দেওয়ালে মাথা ফুটে মুত্যুবরণ করে অব্যাহতি লাভ করবে। ওদের হৃদয় প্রেমহীন বিশুদ্ধ মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে। ওরা হয়ে যাবে ¯েœহ, প্রেমহীন জন্তু-জানোয়ার বিশেষের মতই। অনাগত যুগের ওই ভয়ঙ্কর দেওয়াল লিখনটা এখনই পাঠকদের পড়ে নিতে অনুরোধ করছি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট