লিডিং ইউনিভার্সিটিতে অর্থ আত্মসাৎ ও পেশাগত অসদাচরণের দায়ে স্থপতি রাজন দাস চাকুরিচ্যুত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৪:১৬ অপরাহ্ন
ডাক ডেস্ক : অনুমোদনহীনভাবে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থেকে কাজে ফাঁকি, পেশাগত অসদাচরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজের বিপরীতে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ, লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগ বন্ধের হুমকি প্রদানসহ প্রায় অর্ধ ডজন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাসকে চাকুরিচ্যুত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোঃ মফিজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রাজন দাসকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
একটি সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন রাজন দাস। এরপর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তিনি একের পর এক ভঙ্গ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান। কোনরূপ মাষ্টার্স ডিগ্রি ছাড়াই স্নাতক (অনার্স) শ্রেণিতে ৩য় বিভাগ (সিজিপিএ-২.৬৮) পেয়ে কোনমতে শেষ করেন শিক্ষাজীবন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) শর্ত মোতাবেক শিক্ষা জীবনে ৩য় বিভাগ প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার জন্য অযোগ্য হলেও স্থপতি রাজন দাস এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নানান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের তদবির-সুপারিশে বাগিয়ে নিয়েছেন সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ।
লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক হলেও তিনি কাজ করেন ব্যক্তিগত ক্ষিতি স্থপতি নামক ফার্মে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল উপস্থিতি তালিকা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাজন দাস বিগত এক বছরে মোট কর্মদিবসের প্রায় ২২ শতাংশ অনুমোদনহীনভাবে অনুপস্থিত থেকেছেন। তার বিরুদ্ধে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিলম্বে কর্মস্থলে উপস্থিতি এবং পাঠদানে অনীহার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মৌখিকভাবে তাকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও তিনি কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় কোন কর্ণপাত করেননি।
সূত্র মতে, ২০১৪ সাল থেকে লিডিং ইউনিভার্সিটির কামালবাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ ও বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হন তিনি। ঠিকাদারের সাথে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় একাডেমিক ভবন নির্মাণ, শহিদ মিনার, বঙ্গবন্ধু চত্বর নির্মাণ, শেখ রাসেল এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, নির্মাণ কাজের বিপরীতে উচ্চ হারে বিল উত্তোলনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এতে নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপাচার্য ড. কাজী আজিজুল মওলার সুপারিশে গঠিত হয় ‘নির্মাণ ব্যয় মূল্যায়ন ও বিল যাচাইবাছাই কমিটি’। ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে রাজন দাশের দুর্নীতির চিত্র। দীর্ঘ দেড় মাস সরেজমিন তদন্ত শেষে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত মালামাল, কাজের বিপরীতে প্রদত্ত বিল, ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থের হিসাবে গরমিল পায় যাচাইবাছাই সম্পর্কিত বিশেষ কমিটি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজের বিপরীতে ১১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন স্থপতি রাজন দাসসহ একটি চক্র। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ রাজন দাস সহ জড়িতদের কাছে ব্যাখ্যা চায় এ বছরের ১২ মার্চ। রাজন দাসের প্রদত্ত ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় চলতি বছর ৩ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি স্থপতি রাজন দাসসহ অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের সদস্যরা। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধসহ শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করার হুমকি ধামকিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে জড়িতরা। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ বিগত ৯ অক্টোবর পেশাগত অসদাচরণের কারণ দর্শানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয় স্থপতি রাজন দাসকে। রাজন দাস বরাবরের মতোই নোটিশের জবাব এড়িয়ে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দাবি করেন। কর্তৃপক্ষ সময় মঞ্জুর না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক চাকুরি থেকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে, লিডিং ইউনিভার্সিটির ৭০তম সিন্ডিকেট সভায় স্থপতি রাজন দাসের বহিষ্কারাদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের ২৩ তম সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজন স্যারকে বেআইনিভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তবে, তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ এবং বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়টি আমাদের জানা ছিলো না। জুনিয়রদের মাঝেও বিষয়টি ভুলভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপত্য বিভাগের অস্থায়ী শিক্ষক আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীসহ বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হবার খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ডীন এবং প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত হন এবং তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়।
লিডিং ইউনিভার্সিটির প্রক্টর মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, স্থাপত্য বিভাগের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে উত্তেজিত করা হয়েছে। আমরা তাদেরকে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের অবস্থানের সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে যান দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি সামসুদ্দোহা এবং কামাল বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম। শ্রেণীকক্ষে পড়ার পরিবেশ ও সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন তারা। এসময় ওসি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে শিক্ষার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে অতীতের মতো আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।