উচ্চশিক্ষায় আমরা কতটা সফল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১:৪৩:৪৩ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট (¯œাতক-সম্মান) ভর্তি পরীক্ষায় এবার (২০২৩ সালে) অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তীর্ণ (ভর্তিযোগ্য) হয়েছেন মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পরিষ্কার করে বললে, পাস নম্বর পেয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক- এই তিন শাখার শিক্ষার্থীরাই এই অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। শুধু এবার নয়; কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত কলা অনুষদের অধীন খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন মাত্র দুজন। অথচ এই ইউনিট থেকে তখন বিভাগটিতে আসন ছিল ১২৫টি। পরে অবশ্য অন্যভাবে সমস্যার সমাধান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নির্ধারিত আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়। ফলে পাসের হার বেশি হলে সবাই ভর্তি হয়ে যাবেন, এমনটা নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কেন ন্যূনতম পাস নম্বর পান না। শুধু ভর্তি পরীক্ষায় নয়, ভর্তি হয়েও অনেকেই উচ্চ শিক্ষায় পড়াকালে অসুবিধায় পড়েন। আবার ‘কোনোমতে’ উচ্চ শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় অনেক তরুণ-তরুণী বড় ধরনের ধাক্কা খান। একদিকে দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে পড়েন, অন্যদিকে চাকরির বাজারে কাঙ্খিত সুযোগ না পাওয়ায় অনেকেই বেকার থাকছেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন আসলে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাতেই বড় ধরনের গলদ রয়েছে। এই স্তরে দুর্বলতার কারণেই মূলত পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। সরকারি-বেসরকারি একাধিক গবেষণা তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যতোটুকু শেখার কথা, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী তা শিখতে পারছে না। ফলে এই পর্যায়ে যতোটুকু দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা না করেই অনেক শিক্ষার্থী ওপরের শ্রেণিতে উঠছে। এই ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরও পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। যেমন প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ভাষাগত দক্ষতায় খুবই দুর্বল।
বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১ হাজার ৫০০ এর বেশি শিশুর ওপর এক জরিপ চালানো হয়। ১৪ জুন-২০২৩ প্রকাশিত ওই জরিপের তথ্য বলছে, ১০ শতাংশের বেশি ছেলে এবং প্রায় ৯ শতাংশ মেয়ে বাংলায় বর্ণই পড়তে পারেনি। ইংরেজিতে এই হার আরও বেশি। ইংরেজিতে বর্ণ পড়তে পারেনি ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছেলে এবং ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে। এছাড়া বাংলায় গল্প পড়তে পারেনি প্রায় ৬২ শতাংশ ছেলে ও ৫৩ শতাংশ মেয়ে। আর ইংরেজিতে গল্প পড়তে পারেনি প্রায় ৮৫ শতাংশ ছেলে ও প্রায় ৮৩ শতাংশ মেয়ে। গণিতে একক অংক শনাক্ত করতে পারেনি ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৩ শতাংশ মেয়ে। আর ভাগ করতে পারেনি প্রায় ৯৬ শতাংশ ছেলে এবং ৯৭ শতাংশের বেশি মেয়ে। বিদ্যালয়ে পড়–য়া ৭৫১ ছেলে এবং ৭৮২ মেয়ে শিশুর ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছে। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রান্তিক শিশুদের বাড়িতে গিয়ে এই ‘নাগরিক কর্তৃক মূল্যায়ন’ করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। এই জরিপের কিছুদিন আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনার আগে ২০১৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ তখনই প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যা অর্জন করার কথা ছিল, তা করতে পারেনি। এখন এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও আগের তুলনায় অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী জটিল বাক্য ও শব্দ পড়তে পারে না।
এসব গবেষণা তথ্য বলছে, বড় ধরনের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিকে গিয়েও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট (মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ (প্রথম আলো: ২৩ জুন ২০২৩)।
প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকে যেসব দক্ষতা অর্জন করার কথা, সিংহভাগ শিক্ষার্থী তা অর্জন করতে পারছে না। এই ঘাটতির প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক কম- এই অভিযোগ উত্থাপন করে কেউ কেউ বলে থাকেন, এ কারণে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। অভিযোগটি সত্য। কোন কোন বিদ্যালয় আছে, যেগুলোতে শিক্ষার্থী বেশি শিক্ষক কম। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, হাজার হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক আছেন- শিক্ষক অনুপাতে ছাত্র সংখ্যা কম। এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত পাঠদান হয় না কেন? মোট কথা, প্রাথমিকে বিরাট ঘাপলা রয়েছে, এখানে সুষ্ঠু তদারকি নেই বলেই লেখাপড়া হয় না। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো, স্থানে স্থানে ব্যাঙের ছাতার মত কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকার পরও সেখানে সচেতন অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের ভর্তি করতে চান না। এর মূল কারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত পাঠদান করা হয় না। শিক্ষার জন্য মেরুদ- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রথম হোঁচট খায়। এর প্রভাব পড়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে। এরপর উচ্চ শিক্ষায় সে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়, একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষায় ব্যর্থতার মূল সূত্রপাত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই।
উচ্চ শিক্ষায় ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে লাগামহীন শিক্ষাব্যবস্থায়। দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যের কারণে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতেই পারছেন না। ফলে দারিদ্র্যের কারণে অনেক মেধাবীদেরকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। লাগামহীন শিক্ষাবাণিজ্য চলছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- সবখানেই লাগামহীন ঘোড়ার গতিতে যেন বেড়েই চলেছে শিক্ষাব্যয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যয় কোনো মতে সাধ্যের মধ্যে থাকলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ চার্জ আদায় করা হয় অন্তত ১০ গুণ। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় যেন প্রায় শতগুণ হয়ে যায়। ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষাব্যয়েরও নেই বাঁধা ধরা কোনো নিয়ম। সবই যেন চলছে ফ্রি স্টাইলে। শিক্ষার কোনো পর্যায়েই টিউশন ফি নির্ধারণ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় ইচ্ছামতো আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা টিউশন ফি। এমন নৈরাজ্যে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের চরম আর্থিক দুরবস্থার মুখোমুখি হতে হলেও কর্তৃপক্ষের মোটেই টনক নড়ছে না। সঠিক তথ্য মতে, ইংলিশ মিডিয়ামে এক শিশু শিক্ষার্থীকে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি করতেই লেগে যায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আর বার্ষিক ফি রয়েছে আরও প্রায় দুই লাখ টাকা। কেজি থেকে গ্রেড ৫ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক টিউশন ফি নেওয়া হয় ৩১ হাজার ২০০ ডলার, এমন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও রয়েছে এদেশে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৪ লাখ ব্যয় করতে হয় বছরে একজন শিক্ষার্থীর জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষা ব্যয় আকাশচুম্বী। চার বা পাঁচ বছরের ¯œাতক কোর্সের জন্য কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আদায় করছে ১৫ লাখ টাকা। অথচ একই বিষয়ে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো পড়তে লাগছে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন টাকারই খেলা। গ্রামগঞ্জ থেকে শহরাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব স্কুলের শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন পান না। তাই খেয়াল-খুশিমত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে তারা আদায় করছেন গলাকাটা ফি। প্রত্যন্ত গ্রামেও শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ৫০০ থেকে কয়েক হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।
লাগামহীন শিক্ষা ব্যয়ের কারণে উচ্চশিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে লাগে কাড়ি কাড়ি টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর কোর্স শেষ পর্যন্ত ব্যয় করতে হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় ভর্তি ফি ও টিউশন ফি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশনার বাইরে নামে বেনামে বিভিন্ন ফি আদায় করছে মেডিকেল কলেজগুলো। সব মিলে এমবিবিএস কোর্সে শিক্ষার্থীদের খরচ গিয়ে ঠেকছে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গত ১৬ ফেব্রুয়ারির প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বেসরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, ইন্টার্ণশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতি মাসে টিউশন ফি ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি থাকলেও মেডিকেল কলেজগুলোতে খরচ হয় আরও বহুগুণ বেশি। মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির আগে খরচের তালিকা দেখেই শিক্ষার্থী-অভিভাবক নির্বাক হয়ে যান। এত অধিক টাকা খরচ করে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সাধ্য আছে কয়জনের?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিখন ঘাটতিই উচ্চশিক্ষায় ব্যর্থতার মূল কারণ। সেই সাথে লাগামহীন শিক্ষাব্যয় উচ্চশিক্ষায় ব্যর্থতার পথকে আরও সুগম করে দিয়েছে। ইহা মোটেই কাম্য নয়। উচ্চশিক্ষায় ব্যর্থতার উক্ত কারণগুলো দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা সরকারের মহান দায়িত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।