উ›মুক্ত ও দূরশিক্ষণের ৩১ বছর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ৪:২৪:২৫ অপরাহ্ন
মিসবাহ উদ্দিন সুমন
যে পদ্ধতিতে শিক্ষাকে বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা হয় না, শিক্ষা যেখানে প্রথাগত শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ থাকে না, যে পদ্ধতিতে ঘরে বসে যেকোন বয়সে নিজের সুবিধামতো সময়ে শিক্ষা অর্জন করা যায়, তাকে বলা হয় উ›মুক্ত ও দূরশিক্ষণ। দেশের একমাত্র উ›মুক্ত ও দূরশিক্ষণ বিশ^বিদ্যালয়ের নাম বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়। যেকোন ধরনের যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী পন্থায় সর্বস্তরের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষাকে গণমুখীকরণের মাধ্যমে সর্বসাধারণের নিকট শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির লক্ষ্যে ১৯৯২ সলের ২১ অক্টোবর জাতীয় সংসদের ৩৮ নং আইনের মাধ্যমে দেশের ১১তম পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ^বিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। আজ বাউবি ৩১ বছর পূর্ণ করেছে। এই ৩১ বছরের পথ চলায় প্রায় ২৫ লক্ষ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার প্রয়াস পেয়েছে। এই ২৫ লক্ষ দক্ষ জনগোষ্ঠী দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যার সোনালী ধাপে অবস্থান করছে, যাকে বলা হয় উবসড়মৎধঢ়যরপ উরারফবহফ, এদের বয়স ১৫-৬৪ বছর, এরা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যাই বেশি। এ ধারা চলতে থাকবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত। বর্তমান প্রজন্ম কেউ বসে থাকতে চায় না, ছোটখাটো কাজ প্রায় সবাই করে। কর্মব্যস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণ করতে না পারায় বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তিবান্ধব উ›মুক্ত ও দূরশিক্ষণকে বেছে নিচ্ছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি, যা উ›মুক্ত ও দূরশিক্ষণের এক বিশাল ক্ষেত্র তৈরী করেছে।
বর্তমানে বাউবির রয়েছে ছয়টি স্কুল বা ফ্যাকাল্টি, এগারটি প্রশাসনিক বিভাগ, বারটি আঞ্চলিক কেন্দ্র, আশিটি উপআঞ্চলিক কেন্দ্র, ১৫৫০টি স্টাডি সেন্টার, ৬৪টি ফরমাল এবং ১৯টি নন-ফরমাল একাডেমিক প্রোগ্রাম এবং ২৪,০৬৭ জন টিউটর। এসএসসি প্রোগ্রাম থেকে এমফিল-পিএইচডি পর্যন্ত প্রায় ৭ লক্ষ শিক্ষার্থী নিয়ে বাউবি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
সমাজের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি বাউবির রয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে শিক্ষার্থীদের লার্নার হিসেবে সম্বোধন করা হয়, শিক্ষককে বলা হয় টিউটর এবং সংযুক্ত স্কুল, কলেজ এবং বিশ^বিদ্যলয়কে বলা হয় স্টাডি সেন্টার। বাউবির ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন এবং পুনঃপরীক্ষার আবেদন অনলাইনে হওয়ায় দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে স্মার্টফোন, লেপটপ, ডেস্কটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে কাঙ্খিত প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া যায়। ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় মানসম্মত বই এবং অন্যান্য পাঠসামগ্রী। যেকোন তথ্যের জন্য বাউবির রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ওয়েব এড্রেস, এছাড়া ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং ৮০ টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার।
বাউবিতে অনলাইন এবং অফলাইন এ দুয়ের সমন্বয়ে মিশ্র পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওহঃবৎধপঃরাব ঠরৎঃঁধষ ঈষধংং ৎড়ড়স, তড়ড়স, ঙঢ়বহ ঞঠ, ডবন জধফরড়, ইঙটঞঁনব ইত্যাদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে পাঠদান করা হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে সংযুক্ত স্টাডি সেন্টারে প্রতি শুক্রবার ফেস-টু-ফেস ক্লাসের আয়োজন করা হয়। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাউবি খুব দ্রুত একটি ভার্চুয়াল বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণত হবে।
বাউবির রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ই-বুক গ্যালারি, যেখানে সকল প্রোগ্রামের বই আপলোড করা আছে। বিশে^র যেকোন প্রান্ত থেকে বাউবির বই বিনামূল্যে ডাউনলোড করে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। স্মার্ট কার্যক্রমের অংশ হিসেব বাউবির রয়েছে ৪টি মোবাইল অ্যাপ। ঈড়সসড়হবিধষঃয ঊফঁপধঃরড়হধষ গবফরধ ঈবহঃবৎ ভড়ৎ অংরধ (ঈঊগঈঅ) এর সহায়তায় বাউবির রয়েছে ঙঢ়বহ ঊফঁপধঃরড়হধষ জবংড়ঁৎপবং (ঙঊজ) প্লাটফর্ম। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি ঈড়সসড়হবিধষঃয ড়ভ খবধৎহরহম (ঈঙখ), অংরধহ অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ঙঢ়বহ টহরাবৎংরঃরবং (অঅঙট), ঈড়সসড়হবিধষঃয ঙঢ়বহ ঝপযড়ড়ষরহম অংংড়পরধঃরড়হ (ঈঙগঙঝঅ), ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁহপরষ ভড়ৎ ঙঢ়বহ ধহফ উরংঃধহপব ঊফঁপধঃরড়হ (ওঈউঊ), ঙঢ়বহ টহরাবৎংরঃু ড়ভ গধষধুংরধ, ণঁহহধহ ঙঢ়বহ টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈযরহধ, ঞযব ইৎরঃরংয ঈড়ঁহপরষ, এষড়নধষ উরংঃধহপব খবধৎহরহম ঈড়হমৎবংং, সহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ৯ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাউবির কলাবরেশন রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, গবেষণা এবং প্রচারের নিমিত্তে বাউবিতে রয়েছে একটি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র। প্রতি বছর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়।
প্রবাসে অনেক বাঙালি রয়েছেন যাদের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে কম বেতনে চাকুরী করছেন। অন্যদিকে কিছু সংখ্যক প্রবাসী বাঙালির শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরেও কাজের দক্ষতা কম থাকায় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশী অভিবাসীদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখার জন্য বাউবি দেশের গ-ি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করেছে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, দুবাই এবং সৌদি আরবে বহিঃবাংলাদেশ নিশ-২ নামে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাউবির কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বংলাদেশীদের দক্ষতা উন্নয়নের এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষায় রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাউবির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হলে পূর্বের তুলনায় অধিক বেতনে চাকুরী পাবে, দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, জিডিপির আকার বাড়বে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে।
লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা (পরীক্ষা), বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্র।