দুর্গা পূজার মাহাত্ম্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ৪:২১:৫৭ অপরাহ্ন
দুলাল শর্মা চৌধুরী
পূজা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সংবর্ধনা, সম্মান, প্রদর্শন, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। মহান দর্শন বা আদর্শ অনুসরণ। সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দুর্গা পূজা। দুর্গা মায়ের আগমনী ছন্দে, এই বাংলার আকাশ বাতাস, প্রকৃতি শিউলি ফুলের মাতাল গন্ধ, ভোরের শিশির ভেজা সবুজ দুর্বা ঘাস, নদীর ধারে কাশফুলের দোলা এসবই দেখতে পাওয়া যায় শরতকালে। মায়ের আগমনে শরতের সুনীল আকাশ, আশ্বিনের অবারিত সবুজের মাঠ সবাই অপেক্ষায় থাকে। মায়ের আগমনীতে ভক্তের হৃদয় ভরে ওঠে নির্মল আনন্দে।
দুর্গা পূজা মূলত শুভ শক্তি আবাহনের পূজা। প্রবাদ আছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বার মাসে তেরো পার্বণ। তবে প্রতিটি পূজা বা পার্বণের নির্দিষ্ট তিথি বা সময় আছে। তেমনি দুর্গা পূজাও একটি। তবে শারদীয় দুর্গা পূজা বর্তমানে সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে। এই সার্বজনীন দুর্গা পূজাকে ঘিরে দেশ-মহাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন। আমাদের দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আশ্বিন মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার আরাধনা করে থাকেন।
দেবী দুর্গা হলেন দুর্গতি নাশিনী অর্থাৎ সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাশুর এর অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এর শরীর থেকে আগুনের মতো তেজোরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল আলোক পুঞ্জে পরিণত হয়। ঐ আলোক পুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত দেবী দুর্গা অসুরকুলকে বধ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মা-ে শান্তি স্থাপন করেন। দেবী দুর্গা মহামায়া, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহা সরস্বতী, শ্রীচ-ী প্রভৃতি নামেও পরিচিত। সর্বশক্তির আধার আদ্যশক্তি হলেন মা দুর্গা। মা দুর্গা নামের মধ্যেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি দুর্গামাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। মা দুর্গা শত্রুর কাছে, পাপীর কাছে যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি সন্তানের কাছে তিনি ¯েœহময়ী। ঈশ্বরের মাতৃরূপের নাম হচ্ছে মা দুর্গা, দেবী মহামায়া। দেবী দুর্গা ১০৮টি বিশেষণে ভূষিত হন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকালে ১০৮টি নীল
পদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেছিলেন। বর্তমানে আমরা রামচন্দ্র অকালে দেবীর বোধন করে যে পূজা করেছিলেন সেটাই অনুসরণ করছি। রামচন্দ্র শরৎকালে যে দুর্গা পূজা করেন সেটাকে বলা হয় অকাল বোধন। নিদ্রিত সময়ে দেবতাদের জাগ্রত করাকেই বলা হয় অকাল বোধন।
রাবণের রাজ্য থেকে প্রিয়তমা স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র শারদীয় দুর্গা পূজার প্রচলন করেছিলেন। আর অন্য যে দুর্গা পূজা ছিল মূল পূজা সেটা এখন বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। অসুরদের রাজা মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা হলেন মহিষাসুর মর্দিনী। তিনি আদ্যশক্তি মহামায়া। সকল পাপ ও অন্যায় কাজের আধার অসুর নিধন করে দেবী দুর্গা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
পাপীর বিনাশে দেবী রণসাজে সজ্জিত হয়ে বিনাশ করেন বলে দেবী রণদেবী। পশুরাজ সিংহ দেবীর বাহন। সাথে দুই পুত্র সেনাপতি কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং দুই মেয়ে ধনের দেবী লক্ষ্মী ও বিদ্যার দেবী সরস্বতী। দেবী দুর্গার চার সন্তানের সাথে ধর্ম, কাম, মোক্ষ জড়িত। দেবী স্বামীগৃহে কৈলাশ থেকে পিত্রালয় মর্তে বেড়াতে আসেন প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে। দেবীর তিনটি চোখ বলে তাকে ত্রিনয়নী বলা হয়। দেবীর বাম চোখ চন্দ্র, ডান চোখ সূর্য এবং কপালের চোখ অগ্নিকে নির্দেশ করে। দেবী দুর্গার দশ হাতে দশটি অস্ত্র শক্তির প্রতীক। দেবীর বাহন সিংহ শক্তির ধারক। দেবীর ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি হচ্ছে যথাক্রমে- ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বান ও শক্তি। বাম দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি হচ্ছে ঢাল, ধনুক, পাশ, অঙ্কুশ ও কঠার। দেবীর অসীম শক্তির প্রতীক হচ্ছে এসব অস্ত্র। বিজয়ার দিনে মহিষাসুরকে বধ করে বিজয়ের উৎসব পালিত হয়। বিজয়া দশমী হলো অনেকেই পূর্ব শত্রুতা ভুলে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় এবং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমন কি বৈশ্বিক সংহতি রক্ষায় এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দুর্গা পূজার মাহাত্ম্য রক্ষায় দুর্গা পূজার গুরুত্ব অনেক। দেবী দুর্গা মানুষের দুর্গতি নাশ করেন বলে তার নাম দুর্গতিনাশিনী।
‘রাবণস্য বিনাশায় রামসানু গ্রহয়ে চ অকালে বোধিতা দেবী’। অর্থাৎ রাবণকে বিনাশের জন্য রামের প্রতি অনুগ্রহ বশত অকালে দেবী দুর্গা বোধিত হয়েছিলেন। দুষ্ট শক্তি রাবণকে বধ করার জন্য রাম নিদ্রিত সময়ে দেবীর পূজা করেছিলেন অকাল বোধনের মাধ্যমে। দুর্গম নামের অসুরকে বধ করে দেবীর নাম হয়েছিল ‘দুর্গা’।
যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা নমস্তৈস্যই, নমস্তৈস্যই নমো: নম:। অর্থাৎ- যে দেবী শক্তিরূপে সর্বজীবে বিরাজিতা তাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
পরিশেষে শারদীয় দুর্গা পূজায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে জানাই দুর্গা পূজার শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও ভালোবাসা। বন্ধ হউক যুদ্ধ. রক্তপাত, হানাহানি, সারা পৃথিবী জুড়ে শারদীয় দুর্গা পূজা নিয়ে আসুক, সৌহার্দ্য, সুখ-শান্তি আর সম্প্রীতি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।