হবিগঞ্জে স্কুলছাত্রী জেরিন হত্যা মামলা
পরিচয় ‘বদল’ করেও রক্ষা হয়নি রুবেলের
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ অক্টোবর ২০২৩, ৪:৩৭:৪৭ অপরাহ্ন
# চেয়ারম্যান-মেম্বারের সহায়তায় তৈরি করা হয় ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদ
কাউসার চৌধুরী
হবিগঞ্জে প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় বখাটেদের হাতে খুন হন মেধাবী স্কুল ছাত্রী মদিনাতুল কুবরা জেরিন। তার তিন ঘাতকের একজন রুবেল মিয়া আদালতে ঘটনার স্বীকারোক্তিও দিয়েছিলেন। অথচ এই হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে চতুর রুবেল নিজের পরিচয় বদল করে ফেলে। তৈরি করে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দার ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। সংগ্রহ করে জন্ম নিবন্ধন সনদও। স্থানীয় চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরিতোষ রায় ও ইউপি সদস্য সাহাব উদ্দিনের সহায়তায় একেবারে ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিলেটের ডাক’র অনুসন্ধানে জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে করা জাল-জালিয়াতির বিষয়টি উঠে এসেছে। অবশ্য, জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয় বদল করলেও ঘাতক রুবেল মিয়ার শেষ রক্ষা হয়নি। সম্প্রতি দিরাই’র কার্তিকপুরে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। রুবেল গ্রেফতার হয়ে শ্রীঘরের বাসিন্দা হলেও জাল-জালিয়াতির মূল হোতা ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য এখনো অধরা।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে সহায়তাকারীদের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়-উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন’র সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, হত্যা মামলার আসামিকে রক্ষা করাও মারাত্মক অপরাধ। এদেরকে হত্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির বিষয়টিও দন্ডনীয় অপরাধ। জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হয় এভাবে হত্যা মামলার আসামিকে বাঁচাতে একের পর এক ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের মৃত রহমত আলীর পুত্র রুবেল মিয়াসহ ৩ আসামির বিরুদ্ধে স্কুল ছাত্রী মদিনাতুল কুবরা জেরিন হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এই হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে রুবেল মিয়া নানান ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেয়। এক সময় সে পালিয়ে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে আত্মগোপন করে। এখানে এসে রুবেল মিয়া থেকে মাসুদ রানা নাম ধারণ করে বসবাসও শুরু করে। গত বছরের ৮ আগস্ট চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সে জন্ম নিবন্ধন সনদও পেয়ে যায়। একইভাবে ওই সময় কার্তিকপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্রও গ্রহণ করে। সম্পূর্ণ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হবিগঞ্জের হত্যা মামলার আসামি রুবেল মিয়া হয়ে যায় মাসুদ রানা।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানের সহায়তায় জালজালিয়াতির মাধ্যমে রুবেল মিয়া নাম পরিচয় পরিবর্তন করে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। জন্ম নিবন্ধন সনদে মাসুদ রানার পিতার নাম আব্দুস ছালাম ও মাতার নাম আফিয়া খাতুন। জন্ম নিবন্ধন নম্বর- ২০০০৯০১২৯১৯১১৫৫৩০। তার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে আছে, কার্তিকপুর, চরনারচর, ওয়ার্ড -৩ চরনারচর, দিরাই, সুনামগঞ্জ। চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরিতোষ রায় ও সচিব সুধীন চন্দ্র সরকার এতে স্বাক্ষর করেন।
একইভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে সে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর-৫৫৭৪২২২০২। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০০০। জন্ম স্থান সুনামগঞ্জ। পেশা- কৃষক। উপরোক্ত জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেশের প্রচলিত জাতীয় পরিচয়পত্র আইন এবং জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
জানা গেছে, যে কার্তিকপুর গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে এই জালিয়াতি করা হয়েছে ওই গ্রামেরই স্থায়ী বাসিন্দা ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য মো. সাহাব উদ্দিন। মাসুদ রানা কার্তিকপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা কিনা -সে বিষয়ে ইউপি সদস্য সাহাব উদ্দিনের জানা থাকার কথা। জেনেশুনেই তিনি ইউপি চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এটি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কেবল কার্তিকপুর গ্রামের বাসিন্দা হয়েই থেমে থাকেননি রুবেল। ওই গ্রামের হাজিল মিয়ার কন্যাকে বিয়ে করতেও দিনক্ষণ পাকাপোক্ত করে। গত ১১ অক্টোবর বুধবার হাজিল মিয়ার বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলে র্যাব-৯ এর একটি বিশেষ টিম কার্তিকপুরে হাজিল মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালায়। রুবেল যখন মাসুদ রানা পরিচয়ে হাতে মেহেদী দিচ্ছিল; ঠিক ওই সময়ই কনের বাড়ি থেকে রুবেলকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তাকে হবিগঞ্জ সদর থানায় হস্তান্তর করা হয় বলে র্যাব-৯ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিয়ার রহমান সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেন।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, হবিগঞ্জের স্কুল ছাত্রী জেরিন হত্যা মামলার আসামি দিরাই’র প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন করে আছে এমন গোপন সংবাদ পেয়ে র্যাব অভিযান চালায়। এ সময় কার্তিকপুর থেকে নাম পরিচয় গোপন করে আত্মগোপনে থাকা পলাতক আসামি রুবেল মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে হবিগঞ্জ সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য মো. সাহাব উদ্দিন সিলেটের ডাককে বলেন, আমার গ্রামের আব্দুস ছালামের স্ত্রী আফিয়া খাতুন তার ছেলের জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে আসেন। তার ছেলের নাম মাসুদ রানা। আমি তার ছেলে হিসেবেই জন্ম সনদ দিয়েছি। আফিয়া খাতুন ভালো বলতে পারবেন-এটি তার ছেলে কি না।
তিনি দাবি করেন, গ্রামের ছেলে হিসেবে তাকে জন্ম নিবন্ধন সনদ দেয়া হয়। আমি কেবল স্বাক্ষর করেছি, কোনো টাকা পয়সা নেইনি।
ইউপি চেয়ারম্যান পরিতোষ রায় বলেন, জন্ম নিবন্ধন সনদ সাধারণত ইউপি সদস্য তৈরি করেন। কারণ, কে স্থায়ী বাসিন্দা তা ইউপি সদস্যই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন। আমি কেবল এতে স্বাক্ষর করেছি। তিনিও আর্থিক বিনিময়ে জন্ম সনদ দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
আফিয়া খাতুন বলেন, ২০০৭ সালে আমার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম হোসাইন আহমদ মামুন। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরীতে বসবাস করছি। কয়েক দিন আগে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদের বিষয়টি লোকমুখে শুনেছি। অথচ এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। জালিয়াতির মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। এই জালিয়াতির বিষয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও দিরাই’র ইউএনও’র নিকট তিনি লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানান।
নিহত স্কুলছাত্রী জেরিনের চাচাতো ভাই আব্দুল মবিন মিজান বলেন, অভিযোগপত্র জমা দেয়ার সময় রুবেল মিয়ার বয়স ১৭ বছর দেয়ায় শিশু আদালতে তার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ঘটনার পর থেকেই সে পলাতক ছিল। নাম পরিচয় পরিবর্তন করে সে দিরাইয়ে আশ্রয় নেয়। র্যাব তাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে শুধু রুবেলের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক সুদীপ্ত দাসের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্যে ধার্য্য রয়েছে।
জানা গেছে, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে এবং রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিনকে একই গ্রামের জাকির হোসেন প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। জাকির তার সহযোগীদের নিয়ে মেয়েটিকে প্রায়শ উত্ত্যক্ত করতো। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি বখাটেরা তাকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে প্রাণরক্ষার্থে অটোরিক্সা থেকে লাফ দেয় জেরিন। ফলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে এবং পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জানুয়ারি সকালে মারা যায় জেরিন। ওইদিন রাতে হবিগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন জেরিনের বাবা আব্দুল হাই। এ ঘটনায় নুর হোসেন ও জাকিরকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে। পরে রুবেল নামে আরো এক যুবককে গ্রেফতার করা হলে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ সুদীপ্ত দাস গত ২১ সেপেম্বর জেরিন হত্যার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জাকির হোসেন ও নুর হোসেনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।