বাঙালির প্রাণের পূজো ও মাহাত্ম্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ৬:১২:০৯ অপরাহ্ন
পাপড়ি রাণী রায়
বর্ষার শেষে আসে শরৎকাল। বাদলধারা হলে সারা বাজে বিদায় সুর। বর্ষা শেষ হয়, দিন হয় সমাপন। শরৎ আসে হিমেল পরশ গায়ে মেখে। বর্ষার শেষে শরৎ যেন পৃথিবীর বুকে সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে হাজির হয়। প্রকৃতির বনে বনে জমে ওঠে সবুজের সমারোহ।
¯িœগ্ধময় মায়াবী শরতের রূপের বর্ণনা শেষ করা যাবে না। তাই তো কবি সাহিত্যিকরা শরতের রূপের মোহে অভিভূত হয়ে কত কবিতা কত শরৎ বন্দনা লিখে গেছেন।
শরৎকালে নদী তীরে জেগে ওঠে কাশবনের শুভ্র হাসি। সাদা সাদা কাশফুলের দোল খেলায় সবার মন জুড়িয়ে যায়। ভোরবেলা অজ¯্র শিউলি ঝরে মনে হয় যেন শিউলি ফুলের বিছানা। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো দল বেঁধে ভাসতে থাকে। হঠাৎ করে বর্ষণ শুরু হয়। দেখলে লাগে আকাশ থেকে আনন্দবারি ঝরছে। মাঝে মাঝে কচি ধানের চারাগুলোকে অপরূপ লাগে। বিলে-ঝিলে ফুটে অজ¯্র শাপলা। আবার পদ্মও ফুটে লাল, সাদা মিশ্রণে। চারদিকে কিসের যেন একটা নেশা। একটা ভাব। কেউ কেউ বলেন, উৎসবের আগমনী বার্তা।
সারা বছর বাঙালিরা অপেক্ষায় থাকে। কখন শরৎ আসবে, দুর্গাপূজা হবে, পূজায় মায়ের রাতুল চরণে সবাই মিলিত হয়ে এক সাথে দিবে প্রাণের অঞ্জলি।
বাঙালি হৃদয়ের প্রাণের পূজো আদ্যাশক্তি মহামায়াকে বরণ করে নেয়ার আয়োজনে বাঙালিরা মত্ত। দুর্গাপূজাই হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। এ পূজা বছরে দু’বার হয়ে থাকে- শরৎকালে ও বসন্তকালে। তবে শারদীয় দুর্গোৎসবই বাঙালিরা ধুমধামের সহিত পালন করে।
কথিত আছে মহারাজ সুরথ প্রথমে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র রাবণকে বিনাশ করার জন্য ব্রহ্মার আদেশে অসময়ে শরৎকালে এ পূজার অনুষ্ঠান করেন। সেজন্য এর নাম অকাল বোধন। এই পূজাই বাঙালির প্রধান ধর্মীয় উৎসব বলে খ্যাত।
দুর্গা শব্দের অর্থ হচ্ছে যা অতি দুঃখে লাভ করা যায়। যে দেবীর অনুগ্রহ কঠোর সাধনা করতে হয় তিনি-ই দুর্গা। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিকে দেবতার মধ্যে ধরে নিতে এক জগজ্জননী রূপ করা হয়েছে। সে মহাশক্তির আরাধনাই দুর্গাপূজা।
প্রভাতের শিশির আর শিউলি মনে জাগায় এক অপূর্ব সজীবতা। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যে বিপণীসমূহ সজ্জিত করে সর্বত্রই আনন্দময়ীর আগমন বার্তা ঘোষণা করতে থাকে। প্রবাসী, ছাত্র-শিক্ষক, চাকরিজীবী সবাই গৃহে ফিরে নিজ পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সর্বত্রই একটা চঞ্চলতা বিরাজ করে- দোকানে ভিড়, রাস্তায় ভিড়। পূজা উপলক্ষে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবকে উপহার দেয়া হয়। এই উপহারের মাঝে লুকানো থাকে ভালোবাসার ছোঁয়া। ষষ্ঠীর দিন যে উৎসব হয়, তাকে বলা হয় মায়ের বোধন। সপ্তমী দিন জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা শুরু হয়। তবে অষ্টমীর দিন পূজার ধুম হয় সবচেয়ে বেশি। কোন কোন জেলাতে কুমারী পূজা হয়ে থাকে। নারীর সম্মানার্থে মাতৃরূপে কুমারীকে বসিয়ে পূজা অর্চনা করা হয়। বেলুড় মঠের কুমারী পূজা প্রসিদ্ধ। স্বয়ং স্বামীজী নিজের হাতে সেখানে কুমারী পূজার সূচনা করে গিয়েছিলেন। মহাভারতেও অর্জুনের কুমারী পূজার উল্লেখ রয়েছে।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন জাঁকজমকভাবে দেবীর আরাধনা করা হয়। ঢাক-ঢোল, কাসর, শঙ্ক ধ্বনির ভিতর দিয়ে পূজা হয় মহাধুমধামে। পুরোহিত পূজো সমাপন করে ভক্তদের মাঝে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ভক্তরা একমুঠো বিল্বপত্র ও পুষ্প হাতে নিয়ে দয়াময়ী দেবীর রাতুল চরণে অঞ্জলি দেয়। দেবীর কাছে ভক্তরা মনের আকুতি জানায়। ম-পে ম-পে ঢাক-ঢোল বাজতে থাকে। প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি হয়। আরতি দর্শনে আবাল বৃদ্ধ বণিতা ম-পে এসে ভিড় জমায়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন মহা ধুমধামে পূজার পর মহাপ্রসাদ সকল ভক্ত গ্রহণ করে পরম তৃপ্তি লাভ করে। কোন কোন ম-পে সারাদিন ব্যাপী প্রসাদ এর ব্যবস্থা থাকে। অতিথিদের জন্য থাকে ফলমূল, মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য যেমন সন্দেশ, মিষ্টি, লুচি, সুজির হালুয়া।
দুর্গাপূজা হলো সর্বজনীন পূজা। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই পূজায় অংশগ্রহণ করে। সকলের মিলন মেলায় দুর্গাপূজা সার্থক হয়। দুর্গাপূজা যেন মানুষের এক সামাজিক চেতনার আনন্দমুখর অভিব্যক্তি। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপ্রবাহ।
চারদিনে দুর্গাপূজা সমাপ্ত হয়। এই ক’দিন যেমন আগমনী গানে দশদিক মুখরিত ছিল তেমনি বিসর্জনের বাজনায় হৃদয় নিরানন্দে ভরে উঠে। দশমীর দিন দেবীকে বিদায় দেবার দিন। দিনান্তে শোভাযাত্রা করে মহাউল্লাসে নিকটবর্তী পুকুর বা নদীতে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
বিসর্জন শেষ হলে পরস্পরের সব রকম বিবাদ ও শত্রুতা ভুলে প্রীতির সাথে কোলাকুলি করে। এটা খুবই আনন্দদায়ক উৎসবের নাম ‘বিজয়া’। বিজয়ায় ছোটরা বড়দেরকে প্রণাম করে। আশীর্বাদ হিসাবে মাথায় হাত রেখে সাধ্যমতো আশীর্বাদ আদান-প্রদান চলে। প্রায় এক সপ্তাহ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ চলে। আবার দেবী ফিরে আসবে, এই আশাতেই বাঙালি হিন্দু একটা বৎসরের জন্য বুক বেঁধে থাকে।
পূজার মাহাত্ম্য। পূজা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সংবর্ধনা, সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধার্ঘ্য, নিবেদন, মহান দর্শন বা আদর্শ অনুসরণ। সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। দুর্গা মায়ের আগমনী ছন্দে ছন্দায়িত হয় ভক্তের মনপ্রাণ। দুর্গাপূজা মূলত: শুভশক্তি আবাহনের পূজা। প্রবাদ আছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারোমাসে তেরো পার্বণ। তবে প্রতিটি পূজা পার্বণের নির্দিষ্ট তিথি বা সময় আছে।
শারদীয় দুর্গাপূজা বর্তমানে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। এই সর্বজনীন পূজাকে ঘিরে দেশ-মহাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন।
দেবী দুর্গা হলেন দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারী। উৎসব হলো আনন্দলাভের মাধ্যম। আভিধানিক অর্থেও ‘উৎসব’ বলতে আনন্দময় অনুষ্ঠানকে বোঝায়। মানবজীবনে উৎসবের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। উৎসব মানুষের সামাজিক চেতনার আনন্দমুখর অভিব্যক্তি।
মায়ের পূজার উদ্দেশ্য বা মাহাত্ম্য হচ্ছে অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা। জগতে ন্যায়বান, শুভ বুদ্ধির মানুষের মঙ্গলের জন্যই মায়ের উদ্ভব। অনেকে ভাবেন সনাতন ধর্ম পুতুল পূজা করে। আসলে সনাতন ধর্মের পূজায় মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী শক্তির আরাধনাই করা হয়। এ বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এক ভক্তের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমরা যেমন বাবার ফটোগ্রাফ দেখতে মৃত বাবার কথা মনে হয় তেমনি মায়ের ছবি দেখলে মা যে আছেন তা অন্তরে বিশ্বাস জন্মায়। তাই বলে সনাতনীরা জড়ের উপাসক নয়, চৈতন্যের উপাসক।
আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দীন দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে শুভ শক্তি নিয়ে দাঁড়ানো। আসুরিক শক্তির কাছে হেরে না গিয়ে সত্যের পক্ষে লড়াই পক্ষে করে সমাজে সাম্য শক্তি প্রতিষ্ঠা করাই মায়ের পূজার উদ্দেশ্য। তাই দুর্গাপূজায় বস্ত্রহীনে বস্ত্র দান ও দরিদ্র অসহায় মানুষকে আর্থিক সাহায্য করা হয়, বাঙালি ভোজের ব্যবস্থা করা হয়।
মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা। মায়ের মতোই দেবীর আবির্ভাব ও ভূমিকা এ জন্যই সকলের মা দুর্গা।
প্রতি বছর শরৎকালে হিমালয়ের কৈলাশ ছেড়ে দুর্গা দেবী মর্ত্যে আসেন। ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টিকে পালন করেন।
আদ্যাশক্তি মহামায়া, মাতৃরূপিনী, জগজ্জননী পূজার মাহাত্ম্যই হলো অসুর নিধন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা। দেবীর আগমনে ধরিত্রী হউক সুজলা সুফলা। মানুষের মাঝে সকল অশান্তির অবসান হউক। পূর্ব বৈরী ভুলে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের সখ্যতা দৃঢ় হওয়াই পূজার মাহাত্ম্য। সর্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজার মহাত্ম্য হলো সাম্য, মৈত্রী, শক্তি ও শান্তি। কল্যাণময়ী দেবীর আগমনে ধরিত্রী হউক সুজল সুফলা, মানুষের মাঝে সকল অশান্তি দূরীভূত হয়ে সম্প্রীতির জয়গান হউক। সর্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় দেবীর আরাধনা।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট।