বিশ্ব তোতলামো সচেতনতা দিবস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ৬:১৬:১৫ অপরাহ্ন
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ (শাফী)
মনের ভাব মুখের ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করে তোলে। কিন্তু কিছু মানুষ ছোটবেলা থেকেই কথা ঠিকভাবে বলতে পারে না। তাদের জিভে আড়ষ্টতা থাকে। কথা বলার স্বাভাবিকতার ছন্দপতনকেই আমরা তোতলামো বুঝে থাকি। তোতলামির সঠিক কারণ না থাকলেও প্রায়ই দেখা যায় অতিরিক্ত টেনশন, কথা বলতে গিয়ে নার্ভাস হওয়া, দ্রুত কথা বলার চেষ্টা করা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেকে তোতলায়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে বেশি তোতলামি দেখা যায়। এই সমস্যার কারণে সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মানুষ হতাশ হয়ে পড়তে পারেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তোতলামি ব্যাপারটাকে আমাদের সমাজে এখনও হাসি-তামাশা-ঠাট্টার বিষয় হিসাবে দেখা হয়। আমরা তাদের প্রতি খুব কম সময়ই সহমর্মী হই। অথচ তাদের এই সংকট উত্তরণে আমাদের আচরণ কখনোই এরকম হওয়া উচিত নয়। সেইজন্যই সচেতনতা তৈরী করতে ১৯৯৮ সালে প্রথম দিবসটি মনোনীত হয় এবং প্রতি বছর ২২ অক্টোবর নিয়ম করে এই দিনটি ‘তোতলামো সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে যে বার্তাটি দেওয়া হয়, এটা একটা সাময়িক রোগ শুধু, এ কারণে কাউকে ব্যঙ্গ করা যাবে না। তোতলামির অনুকরণ করে কাউকে হেয় করা যাবে না। তোতলামির কারণে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। একই কথা বারবার বলতে বাধ্য করা যাবে না।
তোতলামো কেন হয়?
আমাদের স্বরযন্ত্রে শব্দ উৎপন্ন হলেও তা শ্রুতিমধুর করে তুলতে তালু, দাঁত, জিহ্বা, মুখগহ্বর প্রভৃতির সুসমন্বয় থাকা আবশ্যক। এই সমন্বয় সাধন এবং কোন ধ্বনির পর কোন ধ্বনি উচ্চারিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। পুরো প্রক্রিয়ার যেকোনো ধাপে ব্যাঘাত ঘটলে বা অসামঞ্জস্য দেখা দিলে ওই ব্যক্তি তোতলামিতে ভোগেন। যেহেতু নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞরা মুখ এবং মুখ-গহ্বরের চিকিৎসা করে থাকি তাই বিভিন্ন সময় তোতলামো সমস্যা নিয়ে অনেক অভিভাবক প্রথমে আমাদের কাছেও এসে থাকেন। আমরা স্পিচ থেরাপিস্ট দের কাছে রেফার করে থাকি।
তোতলামোর চিকিৎসা :
তোতলামি সারানোর একমাত্র চিকিৎসা ‘থেরাপি’। সঠিক সময়ে থেরাপির মাধ্যমে একজন অভিজ্ঞ স্পিচ থেরাপিস্ট সম্পূর্ণভাবে তোতলামো সারিয়ে তুলতে পারেন। থেরাপির তিনটি ভাগ রয়েছে- ১. ইন্ডিভিজুয়াল থেরাপি, ২. গ্রুপ থেরাপি এবং ৩. কাউন্সেলিং থেরাপি। প্রথম দুটি স্পিচ থেরাপির অংশ। সন্তানের যে কোনও সমস্যা সমাধানে মা-বাবার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। তোতলামোর উপসর্গ দেখা দিলে আগে বাবা-মা বুঝতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তখনই তাদের নিজেদের দ্বারা কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। থেরাপি কথাটা শুনলেই অনেক অভিভাবক ভয় পেয়ে যান, তাই প্রথমেই তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে এই থেরাপি হচ্ছে কথা বলা শিখানোর একটা নিয়ম বা ব্যায়াম। স্পিচ থেরাপি যিনি দেন তাকে স্পিচ থেরাপিস্ট বা তোতলামির ডাক্তার বলে। তোতলামির ডাক্তার খুবই ধৈর্যবান ও যতœশীল হন। তারা রোগীর উপর বিরক্ত না হয়ে বারবার চেষ্টা করে যান রোগীর সমস্যা দূর করতে। বাংলাদেশের প্রায় অনেক স্থানেই স্পিচ থেরাপি চিকিৎসা কেন্দ্র পাওয়া যায়।
মনে রাখবেন কোনও প্রকার অপারেশনেই তোতলামো সারানো সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে এমনকি শহরেও কোনও কোনও হাতুড়ে ডাক্তার তোতলামি সারানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নানা ওষুধ দিয়ে থাকেন। এমনকী নানাপ্রকার পরীক্ষাও করান। এসব কোনও কিছুতেই তোতলামো সারে না।
ভয়কে জয় করতে হবে :
যাদের এধরণের সমস্যা হয় তাদেরকে কথা বলার সময় মন থেকে সকল প্রকার ভীতি আর আতংক দূর করতে হবে। অনেকের মধ্যে তোতলামির কারণে কথা আটকে যাওয়ার একটি ভয় কাজ করে। এই ভয়ের কারণে কথা আরও বেশি জড়িয়ে যায়। কথা আটকে যাওয়ার যে ভয় কাজ করে, তার পেছনে একটি রোগ দায়ী। একে বলে সেলিসমোফোবিয়া। এই রোগটি সম্পূর্ণ মানসিক। এই রোগের কারণে কেউ কেউ সবার সামনে কথা বলতে ভয় পায়। এজন্য নিজের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। ধীরে ধীরে কথা বলার অভ্যাস করুন। অনেক সময় দ্রুত কথা বলতে গিয়ে তোতলামি বেশি প্রকট রূপে দেখা যায়। তবে কারো সাহায্য কিংবা অনুপ্রেরণা পেলেই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। বড়দের অবশ্যই বাড়িতে প্র্যাকটিস করতে হবে।
তোতলামো সমস্যা দূর করতে ঘরোয়া একটি কার্যকর ব্যায়াম :
যারা তোতলামো সমস্যায় ভূগতেছেন তারা স্ট্র ব্যবহার করে জল খান। ঘরে-বাইরে যেখানেই জল খাবেন, একটু কষ্ট করে না হয় স্ট্র দিয়ে জল খান। স্ট্র দিয়ে জল খাওয়াটাও কিন্তু এক ধরণের মুখের ব্যায়াম যা আপনার কথা বলার সমস্যাকে কমাতে পারে। স্ট্র দিয়ে জল খাওয়ার সময় মুখের মধ্যে জিভের যে অবস্থান, তা কিন্তু কথা বলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজারের বড় সাইজের স্ট্র দিয়ে প্রাথমিক ভাবে শুরু করে কিছুদিন পর থেকে স্ট্রয়ের সাইজ ছোট করুন।
লেখক : নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।