সংকটে সক্রিয় ভূমিকার প্রত্যাশা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ৫:২২:৫৪ অপরাহ্ন

আফতাব চৌধুরী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই মার্কিন প্রশাসনের চরিত্রের কুৎসিত রূপ সম্ভবত প্রথমবার পরিস্ফুট হয়ে উঠে। লক্ষ লক্ষ জাপানির জীবন ও স¤পদ নিয়ে সেদিন ছেলেখেলা করেছিল তারা। তারপর থেকেই তারা অন্যের সর্বনাশের বিনিময়ে নিজের দেশের অস্বাভাবিক ধনতান্ত্রিক স্বার্থের খাতিরে দেশে দেশে গায়ের জোর প্রয়োগ করে চরম অসভ্যতা প্রকাশ করে এসেছে। পূর্ব এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও আফ্রিকার অসংখ্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সে নাক গলিয়ে সেখানকার জন জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। এভাবেই সে তার পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের যথেষ্ট প্রয়োগ করে হাজার হাজার শিশু ও বৃদ্ধসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের চিরপঙ্গু করেছে এবং স^াভাবিক জীবনধারাকে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করেছে। নৈতিকতার কোনও প্রশ্ন তার বিকৃত বাসনা তৃপ্ত করতে তাকে অসভ্য আচরণে বাধা দিতে পারেনি। ১৯৬৩ সালে কেনেডি প্রশাসনের উপদেষ্টা ডিন অ্যাচেসন ঠিকই বলেছিলেন, আমেরিকার অবস্থান, স¤মান ও প্রভুত্বের প্রতি যে কোনও প্রত্যাহ¦ানের মোকাবিলার প্রশ্নে আমাদের কাছে নৈতিকতার কোনও মূল্য নেই। সারা বিশ্বের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করার কথাটাই আসলে তার কাছে মূল প্রশ্ন। এ ব্যাপারে সামান্য বাধা তাকে হিংস্র করে তুলে।
প্রশ্ন হল, বিশ্বের আর কোনও দেশে কি সৈ^রতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা দমন-পীড়ন নেই? আমেরিকার তাঁবেদার আরব দেশগুলোতে তাই চলছে। পাকিস্তানেই বা কোন গণতন্ত্রটা আছে? চীনেও তো গণতন্ত্র নেই। মায়ানমারের দিকে তাকানো কি অপরাধ? তারা কি করলো প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে নিজেদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। হাজার হাজার নারী-শিশু যুবকদের গুলি মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে-কেউ বা কোন রাষ্ট্র অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থা বা জাতিসংঘ যারা মাতব্বরি করে তাদের কেউই এর বিরুদ্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপে যাচ্ছেনা? গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের স^ঘোষিত বিশ্ব-অভিভাবক আমেরিকা সে সব দেশের জনগণকে গণতন্ত্র প্রদান করতে বা মার্কিন ভাষায় তাদের স^াধীনতা দিতে দেশগুলোকে আক্রমণ করেনি কেন? সার্বভৌম ইরাকের উপর এবং পরবর্তী পর্যায়ে আফগানিস্তানের উপর গায়ে মানে না আপনি মোড়ল জাতীয় অভিভাবকত্ব খাটাতে আমেরিকাকে অধিকার দিয়েছে কে? ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে নানাভাবে মানুষদের নির্যাতন করলেও শেষ পর্যন্ত খালি হাতে চোরের মতই পালাতে হয়েছিল মার্কিনীদের।
আজ বিশ্বের আবালবৃদ্ধবনিতা জেনে গেছে আমেরিকা বৃটেনকে সঙ্গী করে ইরাক আক্রমণ করেছিল তার তেল ভান্ডারের দখল নিতে। ইরাক বিশ্বের মোট তেলের ষাট শতাংশের মালিক। আরব দুনিয়ার তেল উৎপাদক অধিকাংশ দেশ যেখানে আমেরিকার বগলদাবা হয়ে তাকে সস্তায় তেল রফতানি করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে সমাজবাদী বা বিলাসী সাদ্দাম প্রায় দেড় দশক ধরে তাকে এ ব্যাপারে বাগড়া দিয়ে আসছিল। তাই পুঁজিবাদ ও নব্য ঔপনিবেশিতাবাদের প্রতিভূ যুদ্ধবাজ আমেরিকার এ বর্বরোচিত ইরাক আক্রমণ।
জাতিসংঘ আজ এক কাক-তাড়–য়ায় অবনমিত। দুর্বল দেশগুলোই আজ তাকে মান্য করে। আমাদের মনে আছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে লিগ অব নেশনস গঠিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। কিন্তু এর দুর্বল নেতৃত্বের পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা পৃথিবীকে গ্রাস করেছিল। পুনরায় আতঙ্কিত মানুষ জাতিসংঘ গঠন করলো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। কিন্তু আজ তার অস্তিত্বেরই সংকট দেখা দিয়েছে। বলিষ্ঠভাবে এর টিকে থাকার এখন একটাই প্রাথমিক শর্ত-যুদ্ধোত্তর ইরাক বা আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার প্রচন্ড চাপের কাছে নতি স^ীকার না করে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় মানব জাতির একমাত্র বাসস্থান আমাদের এ পৃথিবী এক অরাজকতাময় স্থানে রূপান্তরিত হয়ে পড়তে বাধ্য। দেশে দেশে জাতি-দাঙ্গা হয়ে উঠবে রোজকার ঘটনা। এদিকে, রাশিয়া ব্লকের সবাই এক জোট হচ্ছে। চীন এবং বাধ্য হয়ে হয়ত ইরান, পাকিস্তান এতে যোগ দিবে, উত্তর কোরিয়াও এ জোটে যোগ দিতে পারে এমন আবাসও পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ, পৃথিবী হয়ত দুটো যুযুধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে যাচ্ছে যা বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবস্থা। মনে হচ্ছে, খুব দ্রুত পৃথিবী তার আদিম যুগে ফিরে যাবে।
কিন্তু সভ্যতা শুরুর পূর্বের আদিমতা আর আজকের আদিমতায় রাত-দিনের ফারাক হয়ে গেছে! পারমাণবিক, রাসায়নিক, জৈবিক ইত্যাদি হাতিয়ারে বলীয়ান আধুনিক আদিমতা সৌরমন্ডলের এ গ্রহটিকে এক লহমায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর মানুষের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? শীর্ষক গ্রন্থে সম্ভাব্য এ ধ্বংসলীলার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গেছেন। তাছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার নিরোধক চুক্তির হয়ত আর কোনও মূল্যই থাকবে না। যার যেমন খুশি অস্ত্র বানিয়ে যাবে আর তার ব্যবহারও করবে।
ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়া যুদ্ধে মজুত অস্ত্র ব্যবহার করে বুশ সাহেবসহ অন্যান্য প্রেসিডেন্টরা দেশের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গুদাম অনেকটা হালকা করে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন নব উদ্যমে নবতম কৌশলযুক্ত মারণাস্ত্র তৈরি করতে মনোনিবেশ করেছিলেন। যাই হোক শেষে তাকেও বেহায়ার মত ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। সব দেখে মনে হয়, পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মারণাস্ত্র প্রয়োগের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এ সম্ভাব্য যুদ্ধ শেষে আর কারও কিছু বলার হয়ত থাকবে না। এ গ্রহে তখন বিরাজ করবে শুধু শূন্যতা ও নিস্তব্ধতা। তাই ধারণা হয়, পৃথিবী আজ সত্যিই বড় বিপন্ন। আর এজন্য দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার রাষ্ট্র প্রধান বাইডেন যিনি কলঙ্কের অধ্যায় রচনায় তৎপর? আমরা কি আশা করতে পারি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকটের সমাধানে এবং নিরীহ মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে কেউ কি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।