কাণ্ডারী হুশিয়ার!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ৮:৫৪:৫৬ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
বিশ্বকবি তাঁর অন্তরে লালিত ইচ্ছাটুকু অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, “প্রশংসা আমাকে লজ্জিত করে, কিন্তু গোপনে আমি প্রশংসার জন্য প্রার্থনা করি।” তবে এই প্রার্থনা যে শুধুই গুরুদেবের প্রার্থনা তা বোধ হয় না। আমার আপনার সবারই হয়তো এমননি প্রার্থনা। আর সেটা যদি পৃথিবীর কোন দেশের সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান করে থাকেন তাতেও আশ্চর্য হবার কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। গোপনে গোপনে প্রশংসার জন্য প্রার্থনা সেটা তো দুষণীয় নয়-ই, প্রশংসার কথা শুনলে নতুন উদ্যমে কাজ করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক অজয় দাশ গুপ্ত তেমনি এক প্রশংসা সূচক নিবন্ধ লিখেন ৬.১০.২০২৩ তারিখের দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় যার শিরোনাম হলো- ‘বিশ্ব আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশকে দেখেছে।’
লেখক তাঁর নিবন্ধে আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মপ্রত্যয়ের প্রশংসাই করেছেন। এখন দেখতে হবে, ভাবতে হবে এবং একেবারেই নিরপেক্ষভাবে ভাবতে হবে যে সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবীদার কিনা। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে একটু পেছনে ফিরে যেতেই হয়। প্রথম বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা মুক্তিযুদ্ধ ¯œাত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই জাতিসংঘের অধিবেশনে সারা বিশ্বে প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এবং সাহসী কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক এক পক্ষ আর শোষিত এক পক্ষে। আমি শোষিতের পক্ষে।’ আমার মনে হয় সেই দিন থেকেই সারা বিশ্বের শোষকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু তথা একাত্তরে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছিলো।
আজ ২০২৩শে এসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অনেকটা পিতার মতোই কিছু কিছু সাহসী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসান এবং এ সংঘাত কেন্দ্র করে আরোপ করা স্যাংশনের অবসান, সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়েই তিনি সাহসী কন্ঠে আমেরিকার স্যাংশনকে অগ্রহণযোগ্য ও অন্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, আমাদেরও এমন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার ও সক্ষমতা রয়েছে এবং সেটি প্রয়োজনবোধ করলে প্রয়োগ করা হবে। ২০২১ সালের স্যাংশন সম্পর্কে তিনি বলেছেন- যাদের দিয়ে জঙ্গিবাদ দমন করা হলো, তাদের ওপর কেন স্যাংশন? তাহলে জঙ্গিবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠলেই যুক্তরাষ্ট্র খুশি থাকে? আর এ বাহিনীকে ট্রেনিং তো যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে। অনেকে বলেন, সবসময় সব সত্য কথা বলা, সমীচীন নয়। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তারপরও কেউ কেউ সত্যকে সত্য বলতে পিছপা হন না। যেমনটি হননি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
এই সত্যকে সত্য বলার পথ কখনো ফুল বিছানো নয়। কাঁটার আঘাত বার বার সহ্য করে এগিয়ে যেতে হয়। এতেই মানুষ মূল্যবান হয়ে উঠেন। আর এই মূল্যবান হয়ে ওঠাও সুখকর নয়। সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এ প্রসঙ্গে নেলসন ম্যা-েলা বলেছেন- ‘তুমি যত মূল্যবান হবে, তত বেশি তুমি সমালোচনার পাত্র হবে।’ যতই তিনি সমালোচনার পাত্র হচ্ছেন ততই তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে নিয়ে যাচ্ছেন। আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। আর এ কারণেই হয়তো যারা একাত্তরে বাংলাদেশের চরম বিরোধী ছিলেন, বন্ধুত্বতো দূরের কথা পাকিদের বর্বরতার ঘোর সমর্থক ছিলেন, তাদেরও কেউ কেউ অতীতের লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছেন- সেই সব শক্তিধর দেশ নাকি বাংলাদেশের ‘পরিক্ষিত’ বন্ধু। ক্ষতি কি? আমাদের জাতির জনক শুরুতেই বলেছেন- সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। আর বাংলাদেশকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে যাবার চালিকা শক্তি তো আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই। এটা অস্বীকার করার অর্থ তো বাস্তবতাকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
এ প্রসঙ্গে বিল গেটস এর একটি উক্তি তো একেবারেই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘বিনা কারণে যখন দেখবেন আপনার শত্রু বেড়ে গেছে তাহলে বুঝবেন আপনি একজন সফল মানুষ। ব্যর্থতার নয়, মানুষ হিংসা করে সফলতায়।’
এমনি এক সফলতার কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে বাঙালি জাতিকে। আর সেই সফলতাকে সফল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ১৯৭০ সালের নৌকার মাধ্যমে। গুটিকয় বিশ্বাসঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতাকে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধু তাঁর নৌকার পালে বাতাস দিয়েছিলেন। সেদিন নৌকার যাত্রী ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘ভায়েরা আমার’। কা-ারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস আর উদারতার কারণে সেদিন কিছু কিছু ইঁদুর উঠেছিলো নৌকায়। ঐ ইঁদুরগুলোই ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট নৌকাকে ফুটো করে দিয়েছিলো। তাতে ডুবতে বসেছিলো নৌকা। সেই ডুবো ডুবো নৌকার হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আজ তিনি সেই নৌকার কা-ারী। বিশ্ব সাগরে তিনি বেয়ে চলেছেন পিতার নৌকা। যে নৌকা সৃষ্ট তরঙ্গ একদিন আয়ূব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সকল ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করেছিলো। সে নৌকারই তিনি আজ সফল কা-ারী। তাঁর এই সফলতার জন্য কবিগুরুর মতো গোপনে তিনি যদি প্রশংসার জন্য একটু প্রার্থনা করেন সেটা কি খুব একটা বেশি চাওয়া হবে? আর এ চাওয়া পূরণে আমরাই বা কেন এতো কার্পণ্যতা প্রকাশ করবো। এতে তো তিনি আরো উৎসাহী হবেন। সাহসী হবেন। আরো শক্ত হাতে কা-ারী দায়িত্ব পালন করতে উদ্যোগী হবেন। বোধ হয় এটাই মানব চরিত্র।
যাকগে সে কথা। আমাদের প্রশংসা পাবার প্রত্যাশায় তো তিনি বসে থাকতে পারেন না। কারণ বঙ্গবন্ধুর রক্ত তাঁর শিরায় শিরায় প্রবাহমান। তিনি হাল ছাড়তে পারেন না। তবে ভয় হয়, শঙ্কা জাগে যাত্রী বেশে কখন জানি ইঁদুরের দল, দল বেধে নৌকায় উঠে যায়। ওদের দাঁত বিশ্বাসঘাতকের দাঁত। ওরা নৌকার তলা ফুটো করে দিতে পারে। ওরা সুযোগ সন্ধানী। মীরজাফর-মোস্তাকের প্রেতাত্মা তাদের গায়ে-গতরে। তাইতো বার বার ভাবি, বার বার বলি- কা-ারী হুশিয়ার।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।