সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ৬:৪৯:৫০ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
মৃত্যুকূপে পরিণত গোটা ফিলিস্তিন। এই মৃত্যুকূপটি কিন্তু নতুন নয়; প্রায় ৭৫ বছর আগের। আর এটি হয়েছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কারণেই। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল এরূপ ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনে। সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ইসরায়েলের ভেতরে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের মিসাইল হামলা ও অভিযানের পর তেলআবিব গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানোর প্রস্তুতি নেয়। ইসরায়েলি বিমান হামলায় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও অসংখ্য আহত হয়েছে। ইসরায়েল সেখানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ঘটে চরম মানবিক বিপর্যয়। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার হাত থেকে রক্ষা পেতে যখন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ ও শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছিল, ঠিক তখনই ইসরায়েল গাজায় হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করলো। ইসরায়েল বীরদর্পে বলেছে, তারা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা থেমে থাকেনি, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় হামাসের ঘাটি নির্মূলের নামে নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেই চলছে। যুদ্ধের নীতি হলো বেসামরিক নাগরিক, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু না করা। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবীদের সুরক্ষা দেওয়া। অথচ ইসরায়েলের বোমার শিকার হচ্ছে হাসপাতাল এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরাও। অর্থাৎ বর্বর ইসরায়েলের হামলা থেকে ফিলিস্তিনিরা কোনোক্রমেই রক্ষা পাচ্ছেন না- এমনকি হাসপাতালের রোগীও রক্ষা পাচ্ছেন না।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। আরব দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শান্তিকামী মানুষ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করেছে; যদিও কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ইসরায়েলের এই নজিরবিহীন নৃশংসতার পেছনে যে পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোর প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও সমর্থন রয়েছে, তা সুস্পষ্ট। ফিলিস্তিনি ভূখ- দখল ও বছরের পর বছর সেখানে হামলা চালানোর পরও পশ্চিমা বিশ্ব সব সময়ই নীরব থেকেছে। অথচ ইসরায়েলের ভেতরে হামাসের অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সব পশ্চিমা দেশ সোচ্চার হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলে গেছেন অভয় দিতে। দ্রুততম সময়ে মার্কিন রণতরি পাঠানো হয়েছে। অথচ গাজায় এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পরও তারা খাদ্য ও ওষুধ পাঠানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। এসব ঘটনা দিবালোকের ন্যায় এটাই প্রমাণিত, ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যে ধ্বংযজ্ঞ চালাচ্ছে তা মার্কিনিদের নির্দেশেই। হাসপাতালে নজিরবিহীন বোমা হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের সেই দেশগুলোও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, যারা এত দিন আক্রমণকারী ও আক্রান্তের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ইরান ও সিরিয়া ইসরায়েলের হুমকির জবাবে পাল্টা হুমকি দিয়েছে।
সিরিয়া-ইয়েমেন যুদ্ধ, এমনকি লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি যখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল এমন মুহূর্তে হামাসের এ হামলা কেন? হামাসের এ হামলার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে গাজা এক ধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। শুধু একটাই করিডর তারা ব্যবহার করতে পারে, যেটি মিসরের সঙ্গে, তা-ও খুব সীমিতভাবে। ছিটমহলে পরিণত হয়ে গাজা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল, সমস্যাসংকুল ও অমানবিকভাবে বসবাসের একটি অঞ্চল। ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন হওয়া, তার মন্ত্রীসভায় যখন চরম ডানপন্থী নেতৃত্ব থাকে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় অথবা অবৈধ সেটেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা থাকেন, তখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, তা বোঝাই যায়। এখন তো সেটি আরও স্পষ্ট, ফিলিস্তিনিদের তারা চিহ্নিত করেছে ‘হিউম্যান অ্যানিমেল’ হিসেবে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক বছর আগে থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের একটি প্রচেষ্টা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব আমিরাত, বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবেরও সেখানে যুক্ত হওয়ার একটি প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছিল। আবার ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও ফিলিস্তিনিদের আরও স্পর্শকাতর করে তোলে। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন মানচিত্র দেখান। সেই মানচিত্রে গাজা ও পশ্চিম তীরের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর মধ্য দিয়ে পুরো ফিলিস্তিনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়। সেখানে তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, সৌদির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন একটি মানচিত্র তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে এ বছরের পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি, প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিরা হত্যার শিকার হচ্ছে। হামাসের হামলার আগ পর্যন্ত সেটি ছিল প্রায় আড়াইশত। প্রতি বছরই এমন চিত্র আমরা দেখতে পাই। এই সবকিছু মিলিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি মনস্তাত্বিক ক্ষোভ তৈরি হয়। তাদের কাছে মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তারা পরিত্যক্ত। সবকিছু মিলিয়ে পিএলওর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় হামাসের ওপর অভ্যন্তরীণ একটি চাপ তৈরি হয় ইসরায়েলের। এই ধারাবাহিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানটা স্পষ্ট করার। যার ফলে হামলাটা আমরা দেখতে পেলাম।
হামাস ইসরায়েলের ভেতরে হামলা করায় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বিচলিত হয়ে গেলেন। ২০০৭ সালে হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজার শাসনভার নেওয়ার পর থেকে ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর বারবার বর্বরোচিত হামলা করলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী একবারও বিচলিত হলেন না। ইসরায়েল ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিন ভূখ- অন্যায়ভাবে দখল করে আছে এবং অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করছে। এতে পশ্চিমা শাসকরা মোটেই বিচলিত হন না। পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণেই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ফিলিস্তিন সমস্যার সার্থক সমাধানে জাতিসংঘকে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিন ভূখ- মুসলমানদেরই। তাই ইহা মুসলমানদের হাতেই ফিরিয়ে দিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট