সিসিকের ৯২৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা
দুই মেয়াদে অন্য সিটির তুলনায় সিসিকের উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে হতাশ মেয়র আরিফ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ৭:১২:০৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯২৫ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর কুশিয়ারা কনভেনশন হলে বাজেট ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল আরিফুল হক চৌধুরীর দুই মেয়াদের শেষ বাজেট । চলতি বছরের ৭ নভেম্বর তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ শেষের ১২ দিন আগে পেশকৃত বাজেট বক্তৃতাকালে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এর প্রশংসা করেন, তেমনি উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রতি সরকারের বৈষম্য ও তার প্রতি অবিচারের অভিযোগ তোলেন। তিনি দুই মেয়াদের পুরোটা সময় পেলে নগরবাসীকে আরো ভালো কিছু উপহার দেয়া যেত বলে আক্ষেপ করেন।
বাজেট বক্তব্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯২৫ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেটে প্রণয়নকৃত আয় ও ব্যয় সমপরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল সর্বাধিক ১০৪০ কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। আগের বাজেটের তুলনায় এবারের বাজটের আকার ১১৫ কোটি ১৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা কম। এবারের বাজেটে হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ সর্বাধিক আয় ৪৮ কোটি ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং রাজস্ব খাতে ১১২ কোটি ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা সর্বাধিক ব্যয় ধরা হয়েছে।
বাজেট বক্তব্যে বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট নগরীর সমস্যা সম্ভাবনার নানা দিক তুলে ধরেন। তাকে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে তাঁর দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অবদানের কথাও তুলে ধরেন।
দীর্ঘ জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকালে নানা দিক তুলে ধরে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রথম মেয়াদে প্রায় দুই বছর ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে কারান্তরীণ রাখা হয়, এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর করোনার কারণে প্রায় দুই বছর স্বাভাবিক উন্নয়ন কর্মকা- থমকে গিয়েছিল। অর্থাৎ দুই মেয়াদের ১০ বছরের মধ্যে প্রায় চার বছরই স্বাভাবিক কর্মকা- ব্যাহত হয়েছে। তারপরও যে সময়টুকু আমি পেয়েছি সিলেট মহানগরবাসীর উন্নয়নে আমি মন প্রাণ সপে দিয়ে আপসহীনভাবে কাজ করেছি। কোনো রক্তচক্ষুকে গ্রাহ্য করিনি। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি।
অপ্রাপ্তি নিয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ২০১৪ সাল থেকে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। চেঙ্গেরখাল নদীতে ৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য বড়শালায় ১৩ একর জায়গা অধিগ্রহণসহ প্লান্ট নির্মাণের ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও আজ পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
একইভাবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বতন্ত্র স্যুয়ারেজ সিস্টেম চালু, যানজট নিরসনের লক্ষ্যে চারটি পার্কিং ব্যবস্থা, ৪টি পৃথক পৃথক খেলার মাঠ ও ৪টি পৃথক পৃথক গরুর হাটের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হলেও এক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তিনি বলেন, শহর রক্ষা বাঁধ, সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার জন্য স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসহ নানাবিধ জনস্বার্থমূলক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক আগে থেকেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার জন্য আমি বারবার সরকারের বিভিন্ন প্লাটফর্মে তাগাদা দেওয়া স্বত্বেও কোন অগ্রগতি নেই। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, গুরুত্ব বিবেচনায় সিলেটের চেয়ে আরো অনেক পিছিয়ে থাকা সিটি কর্পোরেশনকে বড় বড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অন্য সিটি কর্পোরেশন কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশন কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছে-এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের খোজ নিতে বলেন মেয়র।
আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটে ভয়াবহ বন্যার পর সরকারের তরফ থেকে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি, নদী খননসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণে আশ্বাস কেবল আশ্বাসেই ছিল বলে হতাশা ব্যক্ত করেন।
আরিফুল হক চৌধুরী তার দুই মেয়াদের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে বলেন, আগামীর সমৃদ্ধ সিলেট গড়তে হলে ‘দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা’ গ্রহণ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেকটা সহজ হলেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। অথচ ‘আগামীর সিলেট’ কিংবা আজ থেকে ৫০ বছর পর আমরা কিভাবে সিলেট নগরীকে দেখতে চাই, তার চিন্তাভাবনা শুরু করা জরুরি।
সবাই মিলে পরিকল্পনামাফিক কাজ করলে ‘নতুন সিলেট’ গড়া খুবই সম্ভব। এই ‘নতুন সিলেট’ হবে পরিচ্ছন্ন। এই ‘নতুন সিলেট’-এ থাকবে না কোন যানজট। এই ‘নতুন সিলেট’-এ থাকবে মেট্রোরেল। এয়ারপোর্ট, বাস টার্মিনাল কিংবা রেল স্টেশনে নেমেই যাত্রীরা মেট্রোরেলে চড়ে সহজেই চলে যাবেন তাদের গন্তব্যে। থাকবে খোলা উদ্যান। থাকবে সাইকেল লেন। থাকবে বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং ভবন। মার্কেটে মার্কেটে হেঁটে হেঁটে শপিং করবেন নাগরিকরা। এই ‘নতুন সিলেট’-কোন অলীক স্বপ্ন নয়। এই ‘নতুন সিলেট’ গড়া খুবই সম্ভব। প্রয়োজন সঠিক সুন্দর পরিকল্পনা-সরকারের সদিচ্ছা, সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাজেট ঘোষণাকালে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আশু সুস্থতার জন্য সিলেটবাসী তথা দেশবাসীর প্রতি দোয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’ এর আগে বাজেট বক্তৃতার শুরুতে খালেদা জিয়া ও তার দল সম্পর্কে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা জানেন আমি ছাত্র অবস্থা থেকে বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন, আমার মাতৃতুল্য পরম শ্রদ্ধাভাজন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সিলেটবাসীর অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও দোয়ার কারণে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমি দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে সিলেটবাসীর খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য।
সিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল আলিম শাহ’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি মাওলানা জসিম উদ্দিন, গীতা পাঠ করেন সিসিকের সহকারি কর কর্মকর্তা জ্যোতিস চক্রবর্তী, ত্রিপিঠক পাঠ করেন সিলেট বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ মহানাম ভিক্ষু এবং বাইবেল পাঠ করেন সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চের রেভারেন্ড ফিলিপ সমদ্দার।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৭ নভেম্বর মেয়াদ শেষ হচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন আইন) ২০০৯ এর ৬ ধারা মোতাবেক ৮ নভেম্বর দায়িত্ব নেবেন নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।