প্রশিক্ষকের গুণাবলি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪২:৫৭ অপরাহ্ন
আবু নছর মোহাম্মদ সুফিয়ান
মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান প্রশিক্ষক হওয়া তাদেরই সাজে। এ পেশায় প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, প্রচুর প্রশিক্ষণ নিতে হয়, নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য প্রচুর সময় দিতে হয়। সর্বোপরি পরিবর্তনে বিশ্বাসী ও ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী হতে হয়। যারা পাবলিক স্পিকিং এ ভাল তারা সাধারণত ভাল প্রশিক্ষক হতে পারেন। তবে একজন ভাল প্রশিক্ষক হতে হলে পাবলিক স্পিকিং এর পাশাপাশি নিম্নোক্ত যোগ্যতা সমুহ থাকা আবশ্যক।
একজন প্রশিক্ষক মানেই একজন ভাল শিক্ষার্থী। বিশ্বাস করুন আপনি প্রশিক্ষক হওয়ার পর পরই আপনাকে জীবনব্যাপী শিক্ষার্থী হয়ে যেতে হবে। আপনার প্রশিক্ষণের বিষয়ে আপনার পুরোপুরি ও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।অগভীর জ্ঞান ও ভাসা ভাসা পড়াশোনা নিয়ে আপনি কোনমতেই ভাল প্রশিক্ষক হতে পারবেন না।
প্রশিক্ষণে যারা আপনার সামনে বসে আছেন তাদের উপর ফোকাস থাকতে হবে। তাদের চাহিদা, মনস্তত্ত্ব,তাদের জ্ঞানের স্তর,তাদের লার্নিং স্টাইল বুঝতে হবে।
প্রশিক্ষক অবশ্যই প্রত্যাশিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন ও প্রশিক্ষণার্থীদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবেন।তার সম্পর্কে প্রশিক্ষণার্থীদের ইতিবাচক ধারণা থাকতে হবে অথবা প্রশিক্ষণ সময়ে তিনি সেটা তৈরি করে নিবেন।
প্রশিক্ষণের বিষয় বস্তুকে গুছিয়ে উপস্থাপনের কৌশল জানা থাকতে হবে-এটা আপনার নিজস্ব এপ্রোচ, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, বৈচিত্র্যময় শিখন-শেখানো কৌশলের উপর নির্ভর করে।
ট্রেনিং পরিবেশের সাথে অভিযোজন করার দক্ষতা প্রশিক্ষকের থাকতে হবে। ট্রেনিং এর প্রথম পাঁচ মিনিট নির্ধারণ করবে আপনি ট্রেইনার হিসেবে কতটা সফল হবেন। ট্রেইনিদের সাথে সহজে মেশার ক্ষমতা অর্জন করুন। তাহলে প্রশিক্ষণের অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে।
প্রশিক্ষনার্থীদের সাথে বিরোধে জড়াবেন না। উনাদের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনুন। তারপর আপনার মতামত দিন। সব সময় পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করুন। একক কর্তৃত্ব ফলাতে যাবেননা। দলীয় কাজের সময় কাছে গিয়ে সাহায্য দিন। দলের কাছে বসুন, উনাদের কথা একটু শুনুন। তারপর আপনি কিছু ফিডব্যাক দিন।
একজন ভাল কথক, ভাল বক্তা, ভাল উপস্থাপক আপনাকে অবশ্যই হওয়া লাগবে। প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে আপনার কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আপনি যে মেসেজ দিতে চাচ্ছেন সেটা যেন প্রশিক্ষণার্থীরা ধরতে পারে, বুঝতে পারে।
প্রশিক্ষণে বিশেষ করে শিক্ষক প্রশিক্ষণে শিক্ষকেরা তাদের অনেক সমস্যা নিয়ে আসেন- সেটা হতে পারে বিষয়ভিত্তিক, হতে পারে শিখন-শিক্ষণ সংক্রান্ত,হতে পারে খোদ প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন বা সমস্যা তারা উত্থাপন করেন যা প্রসংগের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো কৌশলে এড়িয়ে যেতে হবে আর প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অবশ্যই প্রশিক্ষকের থাকতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশিক্ষকের পুর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রশিক্ষণ কক্ষে প্রবেশের পূর্বে তাকে সম্ভাব্য সমস্যাসমূহের একটা তালিকা তৈরি করে নিতে হবে এবং তার সম্ভাব্য সমাধান নোট করে রাখতে হবে। কিছু সমস্যার সমাধান উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সমাধান করতে হবে। কিছু সমস্যার হয়তো তাৎক্ষণিক সমাধান মাথায় নাও আসতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনভাবেই গোঁজামিল দেওয়া যাবেনা। পরবর্তীতে সেশনে জেনে এসে তা সমাধানের আশ্বাস দিতে হবে। এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই কারন পৃথিবীর কোন মানুষই সবজান্তা নয়।
প্রশিক্ষণ কক্ষে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতানৈক্য,মতভেদ ও দ্বন্দ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষক তাৎক্ষণিকভাবে কোন পক্ষ নিবেননা। তবে সুকৌশলে সঠিক মতের প্রতি তার দৃঢ়তা তিনি প্রদর্শন করবেন। দ্বন্দ নিরসনে তিনি মডারেটর এবং মিডিয়েটরের ভূমিকা পালন করবেন এবং প্রশিক্ষণ ক্লাসে একটা উইন-উইন সিচুয়েশন সৃষ্টি করবেন অর্থাৎ কেউ যাতে নিজেকে লোজার হিসেবে না ভাবে আবার সঠিক মেসেজ পেয়ে তার ভুল ধারণা ভাঙতে পারে প্রশিক্ষককে কৌশলে সেরকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে একজন ট্রেইনারের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কি? উত্তরে আমি বলব- ধৈর্য। প্রথমত সবচেয়ে বড় ধৈর্যের বিষয় হচ্ছে আপনার সামনের সকলেই বসে আছে অথচ আপনি দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মানুষের মূল্যবোধ ও মানসিক চাহিদার সাথে তাল মিলাতে হলে আপনাকে প্রচন্ড ধৈর্যশীল হওয়া লাগবে।
একজন ভাল প্রশিক্ষক অবশ্যই একজন ভাল শ্রোতা। প্রশিক্ষণার্থীদের কথা মনযোগ দিয়ে তাকে শুনতে হবে। তাদের কথায় অমনোযোগী হলে মনে হবে আপনি তাকে/ তাদেরকে সম্মান করছেননা।তাহলে প্রশিক্ষণ কক্ষে তাদের সাথে যে রেপোর্ট অর্থাৎ আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা সেটা হবেনা। তাছাড়া প্রশিক্ষক ভাল শ্রোতা না হলে প্রশিক্ষণার্থীদের কোনভাবেই কার্যকর ফিডব্যাক দিতে পারবেননা।
সৃষ্টিশীলতা একজন প্রশিক্ষকের জাতধর্ম। তিনি সৃজনশীল হলে প্রশিক্ষণ আনন্দময় ও বৈচিত্র্যময় হবে। তাছাড়া প্রশিক্ষকের ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা ও রসবোধ প্রশিক্ষণের পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলে।
প্রশিক্ষককে অবশ্যই শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। শিক্ষাবিজ্ঞান ও শিক্ষামনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা থাকতে হবে এবং ইতিপূর্বে শ্রেণিকক্ষে এগুলোর বাস্তব অনুশীলন করা থাকতে হবে কেননা প্রশিক্ষকের কাজ শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান সরবরাহ করা নয় বরং শিক্ষণ দক্ষতার বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করা। তাছাড়া শিক্ষায় প্রফেশনাল ডিগ্রিবিহীন (বি,এড ও এম,এড) লোক যতই জ্ঞানী হোক ভাল শিক্ষক প্রশিক্ষক হতে পারবেনা।
গবেষণায় দেখা গেছে দেশ ও বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকরাই প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। তাই প্রশিক্ষক হতে চাইলে দেশ ও বিদেশে ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণের সুযোগগুলো হাতছাড়া করা যাবেনা।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি), সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, ও শিক্ষক প্রশিক্ষক।