ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কোন পথে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪৭:১৪ অপরাহ্ন
সৈয়দ মবনু
আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ কারো জন্যই সুখের নয়। তবু পৃথিবীর আদি থেকে যুদ্ধ হচ্ছে এবং পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। মানুষে মানুষে যুদ্ধে মানুষ মরে, মানুষই মরবে, এটা একেবারে সত্য কথা। পৃথিবীতে কোথাও যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন অনেকের অনেক ধরনের স্বার্থ জড়িত থাকে। স্বার্থ কারো হয় বৈধ, কারো অবৈধ। যুদ্ধের বৈধতা, অবৈধতা প্রথমত স্বার্থের বৈধতা-বৈধতার উপর নির্ভর করে। ন্যায়-নীতির বিষয়টি আবার স্বার্থের বৈধতা-অবৈধতার বাইরেও হতে পারে। আবার যুদ্ধের নিজস্ব কিছু নীতি রয়েছে। কিন্তু এই নীতি এবং ন্যায়কথা শুধু গরীব আর দুর্বলদের জন্য। শক্তিমানরা এগুলো না মানলে কেউ কিছু করতে পারবে না।
পৃথিবীতে জাতিসংঘ নামের ধনী ও শক্তিমানদের একটি বৈঠকখানা রয়েছে। এই সংস্থা তৈরী হয়েছে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে, শক্তিমানরা বিপদে আটকে গেলে উদ্ধারের জন্য। তখন এর নাম ছিলো লীগ অব নেশনস। পরে তা পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ইউনাইটেড ন্যাশনস। এটি গঠন করেছিলো বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো। উদ্দেশ্যে ছিলো পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য, যাদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে, তারা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও গণচীন। ওরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশ। আর কারো ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফলে এই পাঁচ দেশ হলো জাতিসংঘের মা-বাপ। এখানে একটাও মুসলিম দেশ নেই, অথচ পৃথিবীতে শতাধিক মুসলিম দেশ রয়েছে। আমরা যদি জাতিসংঘের জন্মলগ্ন বলি, তার নাম পরিবর্তনের সময় থেকে তবে বলতে হবে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর। তখন ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করেছিলো। সেদিন থেকে এই লেখার দিন পর্যন্ত জাতিসংঘের বয়স প্রায় ৭৮ বছর।
এই ৭৮ বছরে জাতিসংঘ পৃথিবীতে যে কাজগুলো করেছে, এর কতভাগ আপনার দেশ-জাতি, সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির পক্ষে এবং কতটুকু বিরুদ্ধে, সেই হিসাব কি আপনি কোনোদিন করেছেন? বিগত ৭৮ বছরে পৃথিবীর যে সকল দেশে যে সকল ঘটনা ঘটেছে, আপনি হিসাব করে দেখুন সেখানে জাতিসংঘের ভূমিকা কার পক্ষে ছিলো এবং তারা কখন কোন মুহূর্তে কীভাবে কার স্বার্থে কাজ করেছে?
বসনিয়া, চেচনিয়া, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, বাংলাদেশ, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে যে যুদ্ধ হয়েছে, অতীতে সেগুলোতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে একটু অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে চেষ্টা করুন ওরা কারা এবং কী চায়?
যেকোন যুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা শান্তির পক্ষে তখনই দেখবেন, যখন শক্তিশালীরা মাইর খেতে শুরু করে। ফিলিস্তিনের বর্তমান বিষয়টিতেও তারা যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ নয়, শান্তিচুক্তি বলতে তখনই শুরু করেছে, যখন প্রতিপক্ষ মরণকামড় দিয়ে আঘাত শুরু করেছে। জাতিসংঘের বয়স আর ইসরায়েল বয়স প্রায় সমান। বিগত দিনে কতবার শান্তিচুক্তি হয়েছে? কে এই চুক্তি ভঙ্গ করেছে? চুক্তি ভঙ্গের পর জাতিসংঘের ভূমিকা কী, তা বিচার করলেই অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।
আমি জাতিসংঘের অপ্রয়োজনীয়তা বলছি না। কিন্তু সে তার প্রয়োজনটুকু পূর্ণ করার শক্তি রাখে না। সে হলো ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিদিরাম সর্দারের মতো একটি প্রতিষ্ঠান। সে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু তাকে সেই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে সুপার শক্তি আমেরিকা করতে দিবে। যেহেতু আমেরিকা ইসরায়েলের পক্ষে, তাই সে আর ফিলিস্তিনের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না। এখন থাকলো বাকী চার দেশ। ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য সবসময়ই আমেরিকার পক্ষে থাকে এবং আজও আছে। রাশিয়া এবং চীন মাঝেমধ্যে নিরব থাকে, মাঝেমধ্যে ওদের পক্ষে যায়, আর মাঝেমধ্যে ওদের বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়। যখন তারা ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন তা হয় মজলুমের পক্ষে। যেমন বর্তমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে তারা ফিলিস্তিনের পক্ষে বলে বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
আর তা হওয়ার কারণও আছে। যুদ্ধটা ছিলো মূলত ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েল ছিলো ইউক্রেনের পক্ষে। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় ইহুদী রাষ্ট্র ইউক্রেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে চেচনিয়ার শক্তিশালী মুসলিম বাহিনী রাশিয়ার পক্ষে মাঠে যুদ্ধ করছে। অন্যদিকে চীনের সাথে ভারতের ধাক্কাধাক্কি তো লেগেই আছে। চীনের সাথে পাকিস্তানের একটি গভীর সম্পর্ক সর্বদাই রয়েছে। ইতোমধ্যে তুরস্ক এবং ইরানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক গভীরে আছে। বাংলাদেশ চীন ভারত বিষয়ে কারো পক্ষে না থাকলেও চীন ও রাশিয়ার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদী আরবসহ আরবের রাজারাও ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমেরিকার বিরুদ্ধে। এখানে একটি নতুন মেরুকরণ হয়ে গেছে। যদি তা অভ্যাহত থাকে, তবে হয়তো জাতিসংঘেও আমেরিকা এককভাবে ফিলিস্তিনের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে পারবে না। সাথে সাথে মাঠে কিছুটা মাপ সমান থাকবে। নতুবা পাল্লার একদিকেই ওজন বেশি থাকবে। অতীতের হিসাব করে যে কারোই সামনে যাওয়া উচিৎ।
লেখক : কবি ও গবেষক।